জার্মানীর উন্মক্ত খনি দেখিয়ে সংসদীয় কমিটি বাংলাদেশে মার্কিন দূতাবাস ও বিভিন্ন বিদেশি সরকারি বেসরকারি কোম্পানির ইচ্ছাপূরণে কাজ করছেন। কিন্তু এই কী কী কারণে বাংলাদেশের সঙ্গে জার্মানী তুলনীয় নয় তা নিয়ে বাংলাদেশের ভূতাত্ত্বিক, প্রকৌশলীসহ বিশেষজ্ঞরা অনেকবার ব্যাখ্যা করেছেন। এগুলো সংক্ষেপে নিম্নরূপঃ
(১) বাংলাদেশের মাটির গঠন, পানির আপেক্ষিক অবস্থান ও গভীরতা, বৃষ্টি ও বন্যার ধরন সবকিছুই জার্মানী থেকে ভিন্ন এবং তা কোনভাবেই উন্মক্ত খনন পদ্ধতির উপযোগী নয়।
(২) বাংলাদেশের জনবসতির ঘনত্ব জার্মানীর তুলনায় এতগুন বেশি যে তা কোনভাবেই তুলনীয় হতে পারে না। বাংলাদেশের গড় জনঘনত্ব প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১০৭৯, জার্মানীর তুলনায় প্রায় ৫ গুণ বেশি। জার্মানীর হামবাক খনি এলাকার তুলনায় বড়পুকুরিয়া ও ফুলবাড়ী অঞ্চলে তা আরও অনেক বেশি।
(৩) জার্মানীতে যেমন এক অঞ্চলের মানুষদের সরিয়ে অন্যত্র নতুন জনবসতি স্থাপন করা গেলেও বাংলাদেশে তা কোনভাবেই সম্ভব নয়। সারাদেশে জনঘনত্ব অনেকবেশি থাকবার ফলে এক অঞ্চল থেকে সরিয়ে বসতি এবং সমাজ জীবন প্রতিস্থাপন একেবারেই অসম্ভব।
(৪) বিষয়টা শুধু ফুলবাড়ী বা বড়পুকুরিয়া অঞ্চলের নয়। সমগ্র উত্তরবঙ্গে যদি কৃষি আবাদ, পানি ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয় তাহলে এই পুরো অঞ্চলই মানুষের বসবাস ও আবাদের অযোগ্য হয়ে যাবে। তাদের সবার জন্যই ভিন্ন আবাস, কৃষি আবাদ আর সমাজজীবন প্রতিস্থাপন করতে হবে। সেটা কোথায়? আর অবিরাম খাদ্য উৎপাদনের এলাকা ধ্বংস হয়ে খাদ্য উৎপাদনের যে ঘাটতি হবে তার সমাধান কী হবে?
(৫) বাংলাদেশের নদনদী খালবিল জালের মতো ছড়ানো যা জার্মানীতে নয়। একজায়গায় দূষণ ঘটলে তা দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। বন্যায় যার তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়। উন্মক্ত খনন পদ্ধতিতে দূষণ তাই বাংলাদেশে যেভাবে ছড়াবে জার্মানীতে ততটা হয় না। ভূগর্ভস্থ পানি প্রত্যাহারের যে প্রয়োজন বাংলাদেশে আছে তাতে মরুকরণের যে বিস্তার ঘটবে জার্মানীতে তার মাত্রা কম। মাটির গঠনের কারণে বাংলাদেশে মাটির ধ্বস যেভাবে ঘটে, জার্মানীতে তার সম্ভাবনা কম।
(৬) জার্মানীর যেসব কোম্পানি এই পদ্ধতিতে কয়লা উত্তোলন করছে সেগুলো জার্মান কোম্পানি। তারপরও এখানে মালিকানা ঐসব কোম্পানির হাতে কেন্দ্রীভূত নয়। বাংলাদেশে সামান্য কিছু রয়ালটির বিনিময়ে পুরো খনি বিদেশি কোম্পানির হাতে তুলে দেয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল, এখনো হচ্ছে।
(৭) জার্মানীতে উন্মক্ত খনন পদ্ধতি ব্যবহার করে কয়লা উত্তোলন করা হয়েছিল অভ্যন্তরীণ বিপুল চাহিদা পূরণের তাগিদ থেকেই। কোম্পানির মুনাফার লক্ষ্যে বিদেশে রপ্তানীর জন্য নয় যেমনটি বাংলাদেশে প্রস্তাব করা হয়েছে।
উল্লেখ্য যে, জার্মানীর এই উন্মক্ত খনন পদ্ধতি তারপরও প্রশ্নের উর্ধ্বে নয়। এর ক্ষয়ক্ষতির তালিকা দীর্ঘ। জার্মানীতে এই খনির জন্য '২৪৪টি গ্রাম নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। পানি চিরদিনের জন্য টলটলে দেখালেও বিষাক্ত।' জার্মান রাষ্ট্রের অনেক দক্ষ তত্ত্বাবধান ও পরিবেশ দূষণ রোধে ব্যয়বহুল ব্যবস্থা গ্রহণের পরও বিষাক্ত পানি, চাষের অনুপযোগী মাটির তথ্য সর্বজনবিদিত। তাহলে বাংলাদেশের কী অবস্থা ঘটতে পারে?
পৃথিবীর যেসব দেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি প্রচলিত তার মধ্যে অস্ট্রেলিয়া অন্যতম। সেখানকার কয়লা স্তরের গভীরতা খুবই কম। ভূগর্ভে সর্বোচ্চ ১২০ মি. পর্যন্ত বিবেচনা করা হয় উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির জন্য। অস্ট্রেলিয়া অতিকম ঘনবসতিপূর্ণ দেশ হওয়া সত্ত্বেও আবাদি জায়গায় উন্মুক্ত পদ্ধতিতে খনন করার বিরুদ্ধে সে দেশের মানুষ খুবই সোচ্চার। বিহার রাজ্য তথা সমগ্র ভারতের অন্যতম বৃহৎ কয়লাখনি হলো যারিয়া কয়লাখনি, যেখানে ৭০মি. পর্যন্ত উন্মুক্ত পদ্ধতিতে এবং এরপর থেকে নিচের দিকে ভূগর্ভস্থ পদ্ধতিতে খনন করা হয়েছে। জার্মানী, ভারত, অস্ট্রেলিয়া, চীনসহ যেসব দেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি নেওয়া হয়েছে তার সবগুলোই পাহাড় বা মরুভূমিতে এবং দেশীয় সংস্থার মালিকানায়। তাদের জনসংখ্যার ঘনত্ব বাংলাদেশের চাইতে অনেক কম। মাটির উপরের সম্পদ নষ্টের অনুপাত কম। রাষ্ট্রীয় আইন ও তদারকি তুলনামূলক অনেক বেশী। তারপরও এসব দেশে নতুন করে আর এই পদ্ধতি গ্রহণ করছে না।
আর্জেন্টিনা, পেরু, কোস্টারিকা, ইকুয়েডর এমনকি যুক্তরাষ্ট্র গত কয়েককবছরে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতির বিরুদ্ধে নানামাত্রার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে। গুয়েতেমালা, হন্ডুরাস, যুক্তরাজ্যের ওয়েলসসহ বিভিন্ন দেশে উন্মুক্ত খনন পদ্ধতি বাতিলের দাবীতে বিভিন্ন ধরণের আন্দোলন-সংগ্রাম পরিচালিত হচ্ছে। কয়েক বছর আগে মার্কিন সরকার মন্টানা সীমান্তের কাছে কানাডার একটি উন্মুক্ত খনির উদ্যোগের বিরুদ্ধে প্রবল আপত্তি জানিয়েছিল। আপত্তির কারণ হিসেবে বলা হয়েছিল, মার্কিন সীমান্ত থেকে ২৫ মাইল উত্তরে পাহাড়ী অঞ্চলে এই উন্মুক্ত খনি করলে তাতে তাদের সীমানায় গ্লেসিয়ার ন্যাশনাল পার্ক, ঝর্না ও পশ্চিমাঞ্চলের বৃহত্তম প্রাকৃতিক লেকের অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে যাবে।
কোন মন্তব্য নেই:
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন