Powered By Blogger

শুক্রবার, ১ ফেব্রুয়ারী, ২০১৩

পদ্মায় মান ডুবলেও আশা ডোবেনি


বিশ্বব্যাংক সরকারকে যে ‘বাঁশ’ দিয়েছে, তা দিয়ে সেতু না হোক, সাঁকো নির্মাণের চেষ্টা করে দেখতে পারে সরকার। পরিহাস হলো, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী আবুল হোসেনের ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানের নামও সাকো ইন্টারন্যাশনাল। হিন্দু ঐতিহ্যে কেউ মারা গেলে তাঁর নামের ওপরে চন্দ্রবিন্দু যোগ করার একটা রীতি ছিল। সেই অর্থে সাকো ইন্টারন্যাশনালকে আমরা ‘সাঁকো ইন্টারন্যাশনালও’ ডাকতে পারি। সাকো নতুন করে ‘দুর্নীতিগ্রস্ত’ হিসেবে বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংকে ‘ইন্টারন্যাশনাল’ করেছে। এই কাণ্ডকারখানায় জিতল বিশ্বব্যাংক ও সাকো, হারল বাংলাদেশ। 
পদ্মা সেতু নিয়ে বিশ্বব্যাংকের দেশীয় প্রতিপক্ষ কে? এক কথার উত্তর, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সাহেব স্বয়ং। তাঁর পেছনে কোন কোন ব্যক্তি আছেন, আমরা জানি না। তবে দেখা যাচ্ছে, আবুল হোসেন এবং গংয়ের গোলানো কালিমা সরকার নিজের গায়ে মেখে গর্ব করছে যে, আমরা বিশ্বব্যাংককে ‘না’ করে দিয়েছি! অপমানে যিনি হাসতে পারেন, তিনি মহান। কিন্তু আমাদের মনে পড়ছে এই কথাটা, সেই তো নথ খসালি, তবে কেন লোক হাসালি? 
হাসির প্রশ্নটা আসছে, কারণ বিশ্বব্যাংক প্রথমে চুক্তি বাতিল করেছে, তারপর দুর্নীতির অভিযোগ নিয়ে পাবলিক স্তরে প্রচার করেছে, নিজস্ব তদন্ত দল পাঠিয়ে হম্বিতম্বি করেছে। এর সবকিছুতেই বাংলাদেশ রাষ্ট্র হিসেবে, দেশ হিসেবে হেয় হলেও সরকারের গর্বের কমতি হয়নি। বরং অর্থমন্ত্রীর অক্ষয় হাসিমুখ দেখে আমাদেরও হাসি পেয়েছে। 
সর্বশেষ আবুল হোসেনকে মামলার বাইরে রেখে বিশ্বব্যাংককে সরে দাঁড়ানোর বৈধতা জুগিয়েছে দুদক। যদি দুর্নীতি হয়েছে বলে স্বীকার করি, তাহলে গোড়াতেই ব্যবস্থা নিলে এত বিপর্যয় হতো না। এখন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী যেভাবে তাজরীনের মালিক দেলওয়ার হোসেনের সাফাই গাইছেন, তখন সরকারের অনেক কর্তাব্যক্তি আবুল হোসেনের সাফাই গাইতে কসুর করেননি, বিব্রত বোধ করেননি। সচিব দুর্নীতি করেছেন অথচ মন্ত্রী জানেনই না, তা শিশুও বিশ্বাস করবে না। এতভাবে সেতু প্রকল্পকে অনিশ্চিত করার পর, নিজের পায়ে নিজে কুড়াল মারার পর এখন বিশ্বব্যাংককে ‘না’ বলায় কিছু রক্ষা হয় না। বরং এই ‘না’ দুর্নীতির পরোক্ষ স্বীকারোক্তিই হয়ে দাঁড়াল। কারণ সরকার বলতে পারছে না, দুর্নীতি হয়নি। বলতে পারছে না, আবুল হোসেন নির্দোষ। বলতে পারছে না, বিশ্বব্যাংক এখতিয়ারের বাইরে ক্ষমতাচর্চা করেছে। পারছে না নিজের দোষে। এই দোষের দোষী বাংলাদেশের জনগণ হতে রাজি হবে না। সরকার এখানে জাতীয় স্বার্থ দেখার বদলে ব্যক্তির বা গোষ্ঠীর স্বার্থকেই বড় করে দেখেছে। এটা ঢাকতে গোপনে আপস করার চেষ্টা করেছে, আর জনসভায় করেছে বড়াই। কারণ যা-ই হোক, দুর্নীতিতে অভিযুক্ত একজনকে বাঁচাতে সরকার এখানে দেশের ভাবমূর্তি জলাঞ্জলি দিল। অন্যদিকে, বিএনপি জোটের আচরণ ছিল পোড়া গুদামের আলুতে লবণ লাগিয়ে খাওয়ার মতো। সরকারের অপদস্থতায় তারা খুশি হয়েছে, দেশের ক্ষতির কথা চিন্তাই করেনি। 
এভাবে দুর্নীতির পাঁয়তারার অভিযোগে পুরো প্রকল্পই বাতিল করে দেওয়ার নজির বিশ্বে বিরল। ভারতে বিশ্বব্যাংকের ঋণে এইডস পরীক্ষার যন্ত্র কেনায় বিরাট দুর্নীতি হলেও প্রকল্প বাতিল হয়নি। প্রকল্পও চলছে, দুর্নীতির তদন্তও চলছে। বিশ্বব্যাংক এমন বৈরিতা চীন বা মালয়েশিয়ার সঙ্গে করার সাহস করত না। কারণ, সেসব দেশের সরকারের কোমরের জোর আর আত্মসম্মান অনেক বেশি। এ রকম আনাড়িপনা কোনো কাজেরই না। এমন না যে ভারত বা চীনে দুর্নীতি একেবারে কম। কিন্তু বাংলাদেশের সঙ্গে বিশ্বব্যাংক এমনটা করতে পেরেছে, সরকারের অদক্ষতা, বালখিল্য ও দুর্নীতিবাজদের ঢাল হওয়ার কারণে। যুক্তরাষ্ট্রনিয়ন্ত্রিত বিশ্বব্যাংকের অন্য কোনো রাজনৈতিক অভিপ্রায়ও থাকা অসম্ভব নয়। ড. ইউনূসের সঙ্গে সরকারের আচরণও এই বৈরিতায় ইন্ধন জুগিয়ে থাকতে পারে। কিন্তু এসব কথা আজ কে শুনবে?
বিশেষজ্ঞ ও অর্থনীতিবিদদের তরফে যখন বারবার বলা হচ্ছিল, যমুনা সেতু বানাতে পারলে পদ্মা সেতুও নিজস্ব অর্থায়নে বানানো সম্ভব। পাঁচ বছরে যে পরিমাণ অর্থ ব্যয় হবে, বছরওয়ারি হিসেবে তা বহনের সামর্থ্য বাংলাদেশের আছে। বৈদেশিক রিজার্ভ, রেমিট্যান্স-প্রবাহ ইত্যাদি সেই আশাবাদের ভিত্তি হতে পারত। প্রবাসীদের বিনিয়োগের সুযোগ করে দিলেও কাজ হতো। উপায়ের অভাব ছিল না, অভাব ছিল পরিকল্পনার আর ব্যবস্থাপনার সামর্থ্যের। অথচ কিনা সরকার দলীয়ভাবে চাঁদা সংগ্রহের ঘোষণা দিল। সেই চাঁদা আদায় নিয়ে রাজশাহীতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষ মারামারিও বাধাল। এমন সব হাস্যকর কর্মকাণ্ড কেবল ছাত্রলীগই দেখায়নি, সরকারের শীর্ষ নেতৃত্বও দিনের পর দিন দেখিয়ে গেছে। এসবের কোনো প্রয়োজন ছিল না। 
বিশ্বব্যাংকের বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ অনেক পুরোনো। বিশ্বব্যাংকের সাবেক প্রেসিডেন্ট জোসেফ স্টিগলিজসহ অন্যরা সেসব দুর্নীতির বিষয়ে বই ও প্রতিবেদন প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশেও গত বিএনপি সরকারের আমলে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়ন ও তত্ত্বাবধানে হাটিকুমরুল সড়ক নির্মাণে দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছিল। তৃতীয় বিশ্বের দরিদ্র দেশগুলোয় বিশ্বব্যাংক বহু অপকর্ম করে থাকে। এসবের কারণে অতিষ্ঠ হয়ে আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকার কয়েকটি দেশ বিশ্বব্যাংক থেকে বেরিয়ে যাওয়া শুরু করেছে। কিন্তু আমাদের বেলায় ঘটল উল্টোটা। বিশ্বব্যাংকেরই ঠেকা ছিল বাংলাদেশের মতো দেশকে ঋণ দেওয়ার। এটাই তাদের ব্যবসা। কিন্তু এখন আমরাই ঠেকে গেলাম।
দুর্নীতি সমস্যা। কিন্তু আরও বড় সমস্যা দুর্নীতিকে জায়েজ করানোর রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক আয়োজন। যে বাংলাদেশ ‘তলাহীন ঝুড়ি’ বদনাম ঘুচিয়ে প্রবৃদ্ধি সাতের ঘরে নেওয়ার মুখে। যে বাংলাদেশ জাতিসংঘের সামাজিক সেবাসূচকে ভারতের থেকে এগিয়ে, সবচেয়ে উন্নয়নশীল ২০টি দেশের তালিকায় ওপরের দিকে, সেই বাংলাদেশ কেবল রাজনৈতিক সুবিধাবাদ ও অপরিণামদর্শিতার জন্য এ রকম হেনস্তা হতে পারে না। 
ওপরে বলা সাফল্যের শিরোপাগুলি কিন্তু বিশ্বব্যাংকেরই দেওয়া। তাহলে তারাই কেনবা আবার বাংলাদেশকে এমন ব্যর্থ করে দেওয়ায় ব্যতিব্যস্ত হলো? এই প্রশ্নের উত্তর জনগণকেই খুঁজতে হবে। 
বাংলাদেশের সমস্যা নিচে নয়, ওপর মহলে। যে-ই সরকারে বসুক, তাদের রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থাপনা বাংলাদেশের জনগণের বা বাংলাদেশের সার্বিক অর্জনের মানের চেয়ে নিচু। কোনো দেশের ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব যদি সে দেশের জনগণের শিক্ষক ও দিশারি না হয়ে তাদের থেকে নিম্নমানের হয়, তাহলে এমন ধারাই ঘটে। নেতারা আমাদের দায় নেবেন কী, তাঁরাই এখন আমাদের বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছেন! পদ্মা-নাটকে এই সত্যই আবারও ভেসে উঠল। প্রয়াত চিন্তক আহমদ ছফার কথাই আবার ফলে গেল। বহু আগে তিনি বলেছিলেন, ‘আওয়ামী লীগ যখন জেতে কেবল একাই জেতে। কিন্তু যখন হারে, সবাইকে নিয়ে হারে।’ বিশ্বব্যাংকের কাছে এই হার, কেবল দলীয় বা সরকারি হার নয়, এ আমাদের জাতীয় হার। 
কিন্তু এটাই শেষ কথা নয়। এখনো সুযোগ আছে। সরকার যদি বাদবাকি সময়ে দক্ষ, যোগ্য ও সত্ মানুষদের নিয়ে পরিকল্পনা করে প্রকল্প শুরু করতে পারে, যদি নিজেরাই টাকা ও বুদ্ধি জোগাতে পারে, তাহলে যা ছিল মন্দ, তাই হয়ে উঠবে শুভ। আমাদের কেবল একটা বড় দৃষ্টান্ত চাই। নিজেদের এই সুযোগটা সরকারের করে দেওয়া উচিত। অবকাঠামো নির্মাণ যেকোনো দেশের উন্নতির ভিত্তি। আমরা যদি আমাদের যোগাযোগ ও জ্বালানি খাতকে মোটামুটি দুর্নীতিমুক্ত করতে পারি, জাতীয় স্বার্থভিত্তিক নীতি গ্রহণ করতে পারি, তাহলে অন্য খাতের দুর্নীতি সত্ত্বেও দেশ এগিয়ে যাবেই। ভারত এভাবে করেছে। তার জন্য শাসক মহলকে একটা সিদ্ধান্তে আসতে হবে, কম-বেশি টাকা বানানো বন্ধ করা না গেলেও অন্তত গ্যাস ও বিদ্যুত্ এবং পদ্মা সেতুকে দুর্নীতির আওতার বাইরে রাখব। এটা হবে আমাদের অবস্থান উজ্জ্বল করার পরীক্ষা ক্ষেত্র। এ ব্যাপারে যদি গোল্ডেন ফাইভ না পেয়েও কেবল জিপিএ-ফাইভ পাই, তাতেও চলবে। আমাদের নীতি হোক কম, কিন্তু ভালো করে। এটা একবার করতে পারলে, ঋণ দেওয়ার দেশের বা ব্যাংকের অভাব হবে না বিশ্বে। 
যমুনা সেতু এক সরকার শুরু করেছে, আরেক সরকার শেষ করেছে। এ ক্ষেত্রেও তা-ই হতে পারে। যোগাযোগ খাত প্রধান সেই খাত, যেখানে গত ৩০ বছরে সরকার বদলালেও কর্মসূচির বাস্তবায়নে পরম্পরা বিরাজ করেছে। পদ্মা সেতুর বেলায়ও সেটাই হওয়া উচিত। বর্তমান সরকার শুরু করুক, পরে যে আসবে সে শেষ না করে পারবে না। শত হতাশার মধ্যেও এই একটা গাইডলাইন অনুসরণ যদি করতে না পারে, তাহলে সরকার ভোটও হারাবে, মানও হারাবে। মান গেলেও আজকাল অনেক কিছু থাকে, ভোট গেলে কী থাকে তার নজির বর্তমান বিরোধী দল। আপনারা কি সেটা চান? না চাইলে আজই শুরু করে দিন, জনগণ এই একটা ক্ষেত্রে আপনাদের পাশে থাকবে। বাংলাদেশের মানুষ শেষ পর্যন্ত ইতিবাচক। পরীক্ষা করেই দেখুন না প্রধানমন্ত্রী।


ফারুক ওয়াসিফ
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-02-01/news/325851