Powered By Blogger

শুক্রবার, ২৪ জুন, ২০১১

বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পিত লুন্ঠন !!!




ছবিঃ একই কামান দ্বিতীয় বারের মতো "উপহার" দিচ্ছে ভারতীয় বাহিনী

পাচ দিনের সফরে এসে গত কয়েকদিন ভারতীয় সেনাপ্রধান বাংলাদেশে চষে বেড়িয়েছেন। মিটিং করেছেন প্রধান মন্ত্রী, রাষ্ট্রপতি থেকে শুরু করে সব হাই প্রোফাইল নেতাদের সাথে। ঢাকা থেকে প্রকাশিত ভারত-বান্ধব বাংলাদেশী মিডিয়া গুলোর ভাষায় জেনারেল ভিকেসিং (বিজয় কুমার সিংহ) ২৩ জুন বিকেলে ঢাকা ত্যাগের আগ পর্যন্ত ব্যস্ততম সময় কাটিয়েছেন।

যাই হোক, জেনারেল সিংহ তার বাংলাদেশ সফরে দুটি কাজ করেছেন।

একটি হচ্ছে, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা যুদ্ধে ব্যবহত দুটি কামান উপহার/দান করে গেছে্ন। আর বাংলাদেশের এতো দিনের বন্ধুত্বপুর্ণ সম্পর্কে ভাতৃত্বপুর্ণ পর্যায়ে উন্নিত করেছেন। তার এই "উপহার"






ছবিঃ ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে কামান হস্তান্তর মহড়া

পত্রিকা পড়ে "হস্তান্তরিত" এই দুই কামানের ইতিহাস যা জানলাম, তা হলো...

দৈনিক আমাদের সময় লিখেছে,

উলেস্নখ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নামানুসারে ১৯৭১ সালের ২২শে জুলাই ভারতের কোনাবনে গঠন করা হয় বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম গোলন্দাজ ইউনিট ‘মুজিব ব্যাটারী’। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছয়টি ৩·৭ ইঞ্চি হাউইটজার নিয়ে গঠিত এই ইউনিটটি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে। জন্মের মাত্র এক সপ্তাহের মধ্যেই মুজিব ব্যাটারীর কামান গর্জে ওঠে এবং সাফল্যজনকভাবে রণাঙ্গনে শত্রুকে ধ্বংস করার কাজে নিয়োজিত হয়। মুক্তিযুদ্ধকালে এ ইউনিটটি কাইয়ুমপুর, কসবা, সালদানদী, আখাউড়া, নাজিরহাট ইত্যাদি উলেস্নখযোগ্য যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে লক্ষ্যভেদী ফায়ারের মাধ্যমে মুক্তিবাহিনীর বিজয়কে ত্বরান্বিত করে।
Click this link...

অনলাইন সংবাদ মাধ্যম বিডিনিউজ২৪ ডট কম লিখেছে,

বাংলাদেশের স্বাধীনতাযুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর সক্ষমতা বাড়াতে ১৯৭১ সালের ২২ জুলাই ভারতের কোনাবনে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম গোলন্দাজ ইউনিট গঠন করা হয়। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৩ ফুট ৭ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে ৬টি কামান নিয়ে গঠিত এই ইউনিটটি ২ নম্বর সেক্টরের অধীনে মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।

Click this link...

সোজা কথা, ভারত মুক্তিযুদ্ধের সময় মুক্তিবাহিনীকে এই দুটি কামান দান/উপহার দিয়েছিল। সো ফার সো গুড। এই দান বা উপহারের জন্য ভারত অবশ্যিই ধন্যবাদ পাওয়ার যোগ্য।

প্রশ্ন হচ্ছে, ১৯৭১ উপহার দেয়া, যা কিনা বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম কামান, তা আবার ভারতীয় বাহিনীর হাতে গেল কি করে?

প্রশ্নটা করেছেন দুইজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। একজন মেজর (অব) কামরুল হাসান ভুইয়া আরেকজন বংগবীর কাদের সিদ্দিকী।


ছবিঃ মেজর কামরুল হাসান ভুইয়া

দান করা কামান দুটি আবার কি করে ভারতের কাছে গেল, এপ্রসজ্ঞে মেজর কামরুল বলেন,

‘মুজিব ব্যাটারি’ নামে মুক্তিযুদ্ধের সময় ব্যবহৃত যে-দুটি কামান ভারত বাংলাদেশকে উপহার দিচ্ছে, সেই কামানগুলো ভারতের ৫৯ মাউন্টেন রেজিমেন্ট আর্টিলারির ছিল। ওই রেজিমেন্টের ৩ ব্যাটারির ১৮টি কামানের মধ্যে এক ব্যাটারির ৬টি কামান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে ভারত সহায়তা হিসেবে দেয়। মাউন্টেন গান নামের এই কামানগুলো সহজে বহনযোগ্য এবং এগুলো দ্রুত খোলা ও জোড়া দেয়া যায়। পাহাড়ি এলাকায় যুদ্ধের জন্য এই কামান কার্যকর।

গতকাল আমাদের সময়কে এসব তথ্য জানান সেন্টার ফর বাংলাদেশ লিবারেশন ওয়ার স্টাডিজ-এর চেয়ারম্যান ও প্রধান গবেষক মেজর কামরুল হাসান ভূঁইয়া (অব·)। তিনি জানান, এই কামানই বাংলাদেশের প্রথম আর্টিলারি ইউনিট। ১৯৭১ সালের জুলাই মাসের মাঝামাঝি এই কামান মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আসে। ৯ আগস্ট ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর খালেদ মোশাররফ সর্বাধিনায়ক জেনারেল ওসমানীকে এই কামান ব্যবহারের বিষয়ে চিঠি লেখেন।

মেজর কামরুল নিজেও ২ নম্বর সেক্টরের অধীন ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের হয়ে মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিয়েছেন। ওই সময় ৪র্থ ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্ট কুমিলস্নার কাছাকাছি সালদা নদী এলাকায় প্রতিরক্ষা অবস্থানে ছিল। এই রেজিমেন্টের সদরদপ্তর ছিল ভারতীয় সীমান্তেôর ওপারে কোনাবনে। কামানগুলো পরে কোনাবনে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখান থেকে সালদা নদী এবং কসবা এলকায় এই কামান থেকে গোলাবর্ষণ করে মুক্তিযোদ্ধাদের সহায়তা করা হত। যে দুজন অফিসার এই কামান তত্ত্বাবধানের দায়িত্ব পান, তারা হলেন- ক্যাপ্টেন আব্দুল আজিজ পাশা ও সেকেন্ড লেফটেনেন্ট কাইয়ূম।

বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এই কামান কীভাবে ভারতে গেল, সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না। মেজর কামরুল এ প্রসঙ্গে বলেন, এটা মুজিব ব্যাটারির কামান হতে পারে, কিন্তু সেটা কীভাবে ভারতে গেল এটা বাংলাদেশ বা ভারত দুপক্ষের কেউ বলতে পারে না। যদি সত্যি-সত্যিই এটি মুজিব ব্যাটারির কামান হয়, তাহলে ভারতের বক্তব্য যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করা যায়।

মুুজিব ব্যাটারির কামানগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না- এটা অস্বাভাবিক। সামরিক বাহিনীর কোনো অস্ত্র এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। বিশেষ করে কামানের মতো ভারি অস্ত্র। কিন্তু বাস্তôবতা হল, ৬টি কামানের একটি কামানও বাংলাদেশে নেই।

মেজর কামরুল আরো বলেন, যদি এই কামান ভারতে গিয়ে থাকে তাহলে কবে, কার নির্দেশে, কীভাবে গেল তার কোনো তথ্য বাংলাদেশ সরকার বা ভারত সরকারের কাছে নেই। ভারত দুটি কামান ফেরত দিলেও বাকি ৪টির খবর তারা জানেন না। ভারতীয় সেনাপ্রধান যে-দুটি কামান আজ (বৃহস্পতিবার) হস্তôান্তôর করবেন সেই কামান দুটি মুজিব ব্যাটারির হলে ভালো। যদি তা না হয়ে অনুরূপ দুটি কামান হয়, সেটাও আনন্দের; কেননা আমরা সেগুলো দেখিয়ে বলতে পারব, এইরকম কামানই মুক্তিযুদ্ধে ব্যবহৃত হয়েছে। আর উপঢৌকন সবসময় আনন্দের।


বিস্তারিত এখানে, Click this link...

ধন্যবাদ মেজর কামরুলকে, আমাদের কিছু অজানা তথ্য জানানোর জন্য।

...বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর প্রথম এই কামান কীভাবে ভারতে গেল, সে বিষয়ে কেউ কিছু বলতে পারছেন না।........।মুুজিব ব্যাটারির কামানগুলো খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না- এটা অস্বাভাবিক। সামরিক বাহিনীর কোনো অস্ত্র এভাবে হারিয়ে যেতে পারে না। বিশেষ করে কামানের মতো ভারি অস্ত্র। কিন্তু বাস্তôবতা হল, ৬টি কামানের একটি কামানও বাংলাদেশে নেই।

কেউ জানেন না বলে মেজর কামরুল যেটা এড়িয়ে গেছেন সেটা জানার জন্য আমাদের অন্য দুই মুক্তিযুদ্ধার কাছে যেতে হবে। তাদের একজন কাদের সিদ্দিকী আরেকজন মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মরহুম এম এ (মেজর) জলিল।




ভারতের উপহার দেয়া, বাংলাদেশের সেনাবাহিনীর প্রথম কামান দুটি আবার ভারতে গেল কিভাবে?
এ প্রসজ্ঞে ২৩ জুন ২০১১ পলাশী ট্র্যাজেডি দিবস উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় কাদের সিদ্দিকী বলেন,

ভারতীয় সেনাবাহনী ১৯৭১ সালে আমাদের সম্পদ লুট করেছে বলে যে অভিযোগ ছিল তা এত দিন বিশ্বাস করতাম না। কিন্তু সেনাপ্রধানকে স্যালুট দেয়ার দিন থেকে এ অভিযোগ আমি বিশ্বাস করি। তিনি বলেছেন, মুজিব ব্যাটালিয়নের দু’টি কামান আমাদের ফেরত দেবেন। তার মানে আমাদের কামান তারা লুট করে নিয়েছিলেন। তা না হলে ফেরত দেবে কেন।

বিস্তারিত দেখুন এখানে, Click this link...




ভারতীয় বাহিনী সদ্যস্বাধীন হওয়া মুক্ত বাংলাদেশ থেকে কি পরিমান মালামাল, বিশেষ করে ক্যান্টমেন্টগুলো থেকে সামরিক মালামাল লুটপাট করে নিয়ে গেছে, তার সংক্ষিপ্ত বর্ননা পাওয়া যায় মুক্তিযুদ্ধের ৯ নম্বর সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিলের অরক্ষিত স্বাধীনতাই পরাধীনতা বইতে

বাংলাদেশে ভারতীয় বাহিনীর পরিকল্পিত লুন্ঠন শীর্ষক অধ্যায়ে তিনি লিখেছেন,

যারা ১৬ই ডিসেম্বরকে বাঙালীর বিজয় দিবস এবং বাংলাদেশকে সত্যিকার অর্থে স্বাধীন সার্বভৌম বলে মনে করেন এবং এ কথাও বলেন যে, স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশে ভারতীয় সেনাবাহিনী কোন সম্পদ লুটতরাজ করেনি, তারা যে বন্ধু ভারতের কোন দোষ ত্রুটিই অনুসন্ধান করতে রাজী নয় এ কথা বলার আর অপেক্ষা রাখে না।

কিন্তু যারা দেশপ্রেম সমৃদ্ধ মুক্তিযোদ্ধা, সত্যান্বেষী এবং মুক্তিপিপাসু তারা নিজেদের ভূখন্ডকে মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়েই স্বাধীন করেছে বলে বিশ্বাস করে, তারা বাংলাদেশকে ভারতের বিজিত ভূখন্ড বলে কখনই মনে করে না। তারা মনে করে ভারতের সম্প্রসারণবাদী প্রতিক্রিয়াশীল শাসকগোষ্ঠী মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্বে সমগ্র মুক্তিযোদ্ধার ভয়ে ভীত হয়েই বাঙালীর স্বাধীনতা গৌরবকে জবর দখলের মধ্য দিয়ে নিজেদের হীন স্বার্থ উদ্ধার করেছে মাত্র। উপরিউক্ত দ্যান-ধারণায় পুষ্ট দেশপ্রেমিক মুক্তিযোদ্ধারা ১৬ই ডিসেম্বরের পরে মিত্র বাহিনী হিসেবে পরিচিত ভারতীয় সেনাবাহিনীকে নব্য স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সম্পদ, মালামাল লুন্ঠন করতে দেখেছে। সে লুন্ঠন ছিল পরিকল্পিত লুন্ঠন, সৈন্যদের স্বতঃস্ফূর্ত উল্লাসের বিহঃপ্রকাশ স্বরূপ নয়। সে লুন্ঠনের চেহারা ছিল বীভৎস বেপরোয়া। সে লুন্ঠন একটি সচেতন প্রতিক্রিয়ারই ধারাবাহিক কর্মতৎপরতা। মুক্তিযুদ্ধের নবম সেক্টরের অধিপতি হিসেবে আমি সেই ‘মটিভেটেড’ লুন্ঠনের তীব্র বিরোধিতা করেছি- সক্রিয় প্রতিরোধও গড়ে তুলতে চেষ্টা করেছি। লিখিতভাবেও এই লুন্ঠনের প্রতিবাদ জানিয়ে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন, কর্ণেল ওসমানী এবং ভারতীয় পূর্ব অঞ্চলের সর্বাধিনায়ক লেঃ জেনারেল অরোরার কাছে চিঠিও পাঠিয়েছি। তাজউদ্দীন সাহেবের পাবলিক রিলেশন অফিসার জনাব তারেকই আমার সেই চিঠি বহন করে কলকাতায় নিয়েছিলেন। ১৭ই ডিসেম্বর রাতেই সেই বিশেষ চিঠিখানা পাঠানো হয়েছিল। খুলনা শহরে লুটপাটের যে তান্ডব নৃত্য চলেছে তা তখন কে না দেখেছে। ভারতীয় সেনাবাহিনী কর্তৃক সেই লুটপাটের খবর চারিদিক থেকে আসা শুরু করে। পাকিস্তানী বাহিনী কর্তৃক পরিত্যাক্ত কয়েক হাজার সামরিক-বেসামরিক গাড়ী, অস্ত্র, গোলাবারুদসহ আরো অনেক মূল্যবান জিনিসপত্র ট্রাক বোঝাই করে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। ‘প্রাইভের কার’ পর্যন্ত রক্ষা পায়নি, তখনই কেবল আমি খুলনা শহরের প্রাইভেট গাড়িগুলো রিকুইজিশন করে খুলনা সার্কিট হাউজ ময়দানে হেফাযতে রাখার চেষ্টা করি। এর পূর্বে যেখানে যে গাড়ী পেয়েছে সেটাকেই পাঠিয়ে দেয়া হয়েছে সীমান্তের ওপারে।

যশোর সেনানিবাসের প্রত্যেকটি অফিস এবং কোয়ার্টার তন্ন তন্ন করে লুট করেছে। বাথরুমের ‘মিরর’ এবং অন্যান্য ফিটিংসগুলো পর্যন্ত সেই লুটতরাজ থেকে রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি নিরীহ পথযাত্রীরা। কথিত মিত্র বাহিনীর এই ধরনের আচরণ জনগণকে ভীত সন্ত্রস্ত করে তুলেছিল। বাংলাদেশের প্রবেশের সাথে সাথেই যাদের শ্রী এমন তারা যদি বাংলাদেশ ত্যাগ না করে বাংলাদেশের মাটিতেই অবস্থান করতে থাকে, তাহলে কি দশা হবে দেশ ও জাতির। একটি রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে এ কোন ধরনের স্বাধীনতা অর্জন করলাম আমরা, এ ধরনের নানা প্রশ্ন দেখা দিল জনমনে। আমি জনগণ থেকে যেহেতু মোটেই বিচ্ছিন্ন ছিলাম না, সুতরাং ভারতীয় সেনাবাহিনীর আচরণে আমি বিক্ষুব্ধই হয়ে উঠিনি বরং তাদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করার পর্যায়ে চলে গেলাম। খুলনার নিউজপ্রিন্ট মিলের রেস্ট হাউজে অবস্থানরত আমার প্রতিপক্ষ ভারতীয় সেনাবাহিনীর অধিনায়ক মেজর জেনারেল দানবীর সিংকে আমি সতর্ক করে দিয়ে বললাম, ‘দেখা মাত্র গুলির হুকুম দিয়েছি আমি। ভারতীয় সেনাবাহিনীকে লুটতরাজ করা হতে বিরত রাখুন।’

জেনারেল দানবীর আমার হুঁশিয়ারবাণী খুবই হালকাভাবে গ্রহণ করে এমন ভাবখানা দেখালেন যেন আমি তারই অধিনস্থ একজন প্রজামাত্র। তার পরের ইতিহাস খুব দ্রুত ঘটে গেছে। খুলনার বিভিন্ন যায়গায়, যশোর বর্ডারে, সাতক্ষীরা-ভোমরা বর্ডারে ভারতীয় লুটেরা বাহিনীর সঙ্গে বেশ কিছু বাদানুবাদ এবং সংঘর্ষও হয়েছে। ভারতীয় বাহিনীর এ ধরণের আচরণ সম্পর্কে সতর্ক করে দেয়ার জন্য আমি ২১ (?) ডিসেম্বর তারিখ রাত্রে স্টীমার যোগে বরিশাল যাওয়ার উদ্যোগ গ্রহণ করি।

খুলনা পরিত্যাগ করতে হলে নাকি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কমান্ডের হুকুম নিতে হবে-একথা শোনার পরে ভারতের আসল মতলবখানা আমার কাছে পরিস্কার হয়ে উঠল। আমি সেক্টর কমান্ডার হিসেবে ভারতীয় নির্দেশ মেনে চলতে মোটেও বাধ্য ছিলনা না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর ব্যুহ ভেঙ্গে দেশ মুক্ত করলাম ভারতীয় সেনাবাহিনীর নির্দেশ মেনে চলার জন্য নয়। একটি মুক্তিপিপাসু জাতির ভাবাবেগ অনুধাকন করতে ভারতীয় কর্তৃপক্ষ কেবল চরমভাবেই ব্যর্থ হয়নি, বরং অনুধাবন করার সামান্যতম ধৈর্যও প্রদর্শন করেনি তারা। অন্য কথায় তারা কোন কিছুরই তোয়াক্কা করেনি। সংগ্রামী বাংলাদেশ নয়, ভারত যেন একটা মগের মুল্লুক জয় করেছে বলে মনে হলো আমার কাছে। সে যাই হোক, ভারতীয় কর্তৃপক্ষের বাধা-নিষেধের উপেক্ষা করেই আমি দলবলসহ ‘ইনভেসটিগেশন’ জাহাজটিতে চড়ে ২০শে ডিসেম্বরেই বরিশাল অভিমুখে রওয়ানা হই। বরিশাল, পিরোজপুর, ভোলা, পটুয়াখালী ইত্যাদি জায়গাগুলোতে জনসভার আয়োজন করা হয় এবং জনগণকে ভারতীয় বাহিনীর আচরণ সম্পর্কে সচেতন করে দিই। আওয়ামী ছাত্রলীগের যৌথ আয়োজনেই সেই জনসভাগুলো অনুষ্ঠিত হয়। ভারতীয় সেনা বাহিনীর কর্তৃপক্ষ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল অবিলম্বে মুক্তিযোদ্ধাদের নিরস্ত্র করবে এবং সকল অস্ত্র জমা করে সীমান্তের ওপারে নিয়ে যাওয়া হবে। ভারতীয় বাহিনীর এই ষড়যন্ত্রের বিরুদ্ধেও আমি জনসভাগুলোতে সোচ্চার হয়ে উঠলাম। আমার পরিস্কার নির্দেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দী স্বাধীন বাংলার স্থপতি জনগণের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্ত না করা পর্যন্ত বাঙালী জনগণের মুক্তিযুদ্ধ চলতে থাকবে। শেখ মুজিবের হস্তেই কেবল মুক্তিযোদ্ধারা তাদের অস্ত্র সমর্পণ করে দেবে।

আমার এই মহান আহ্বান এবং নির্দেশ মুক্তিযোদ্ধা এবং জনগণের মধ্যে ব্যাপক উদ্দীপনার জন্ম দেয়। বাংলাদেশে অবস্থিত ভারতীয় গোয়েন্দাবাহিনী এবং কট্টর ভারত সমর্থগোষ্ঠী আমার চেতনা এবং অনুভূতির তাৎপর্য সঠিকভাবে বুঝে উঠতে সক্ষম তো হয়নি বরং ভুল বুঝেছে। এখানে একটা বিষয় সকলেরই পরিস্কার হওয়া প্রয়োজন এবং তা হচ্ছে স্বাধীনতার সেই উষালগ্নে বিধ্বস্ত বাংলাদেশের সম্পদ রক্ষা করার যে আগ্রহ এবং বাসনা আমরা প্রদর্শন করেছি তা ছিল আমাদের জাতীয় সম্পদ রক্ষা করারই স্বার্থে কেবল, ভারত বিরোধী হয়ে উঠার জন্য নয়। জাতীয় সম্পদ রক্ষার চেষ্টা কেবল নিঃস্বার্থ দেশপ্রেমেরই লক্ষ, কারো বিরুদ্ধে শত্রুতা সৃষ্টি করার ষড়যন্ত্র মোটেও নয়। বন্ধু ভারত এখানে হিসেবে ভুল করেছে আর তাই দেশপ্রেমের পুরস্কার হিসেবে আমাকে যশোর থেকে ‘এমবুশ’ করে অর্থাৎ গোপনে ওৎ পেতে থেকে ভারত-বাংলাদেশ যৌথ বাহিনী সশস্ত্র উদ্যোগে গ্রেফতার করে।

আমারই সাধের স্বাধীন বাংলায় আমিই হলাম প্রথম রাজবন্দী। ২১শে ডিসেম্বর বেলা ১০টা সাড়ে দশটায় আক্রমণকারী বাহিনীর হাতে বন্দী হয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার আসল রূপের প্রথম দৃশ্য দেখলাম আমি। ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর মদদে বাংলাদেশ স্বাধীন করার অর্থ এবং তাৎপর্য বুঝে উঠতে আমার তখন আর এক মিনিটও বিলম্ব হয়নি।

১৯৭১ সনের সেই ৩১শে ডিসেম্বর রাত ১২টা ১ মিনিটের কথা আমি কোন দিনই ভুলতে পারব না। যশোর সেনা ছাউনির অফিসার কোয়ার্টারের একটি নির্জন বাড়ীতে আমাকে সকাল ১১টায় বন্দী করা হয়। বাড়ী না যেন হানাবাড়ী। ঘুটঘুটে অন্ধকার, আশে-পাশে বেশ কিছু নর-কংকাল পড়ে আছে। ঘরের ভিতর মানুষের রক্তের দাগ। কোন ধর্ষিতা বোনের এলোমেলো ছেঁড়া চুল। বাইরে কাক, শকুন, শেয়াল একযোগে ব্যস্ত। ভেতরে মশারা কামান দাগিয়ে আছে। বাথরুমে পানি নেই। ডিসেম্বরের ভিজে শীত। বাইরে সেন্ট্রির বুটের কটমট আওয়াজ। সারাদিন গেল কোন খাওয়া বা খাবার পানি পর্যন্ত এলো না। ৫ রুম বিশিষ্ট বাড়ীটির রুমে রুমে যেন কান্না আর হাহাকার। সন্ধ্যা হতেই প্যাটার গোঙ্গানি শুরু হয়। সহযোগী ভুতুকও পেছনে পড়ে নেই। বাড়ীটার একটা রুমেও লাইট নেই। একটা খাটের উপর একটা আধছেঁড়া কম্বল এবং তখন সেটাই আমার আপন একমাত্র আশ্রয়স্থল। কোনমতে কম্বলটা জড়িয়ে বসে আছি। রাত ১২টা ১ মিনিটে যশোর সেনাছাউনি নতুন বছরের উজ্জীবনী গীতিতে মুখর হয়ে উঠল। নারী-পুরুষের যৌথ কন্ঠের মন মাতানো সংগীত নাচ, হাত হালি, ঘুঙুরের ঝনঝনানি, উল্লাস, উন্মাদনা সবই ভেসে আসছিল কর্ণকুহরে। আমার মাটিতে প্রথম নববর্ষেই আমি অনুপস্থিত। এ কথা ভাবতেই আমি কানে আর কিছুই শুনতে পেলাম না। শুনলাম কেবল একটা ব্যাঙ্গাক্মক অট্টহাসি। -’রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা” যার অর্থ দাঁড়ায় কতকটা এরকম।

রাতের ঘুটঘুটে সেই অন্ধকারে আমি সেদিন কম্বল জড়িয়েও ঘেমে উঠেছিলাম, শিহরিয়ে উঠেছিলাম পুনঃ পুনঃ। স্বাধীনতার সতের বছর পরেও আমি নিশ্চিত হতে পারছি না। অন্ধকারে আজো আমি একইভাবে শিহরে উঠি আর যেন শুনতে পাই- “রক্ত দিয়ে এই স্বাধীনতা আনলে তোমরা।”


বিস্তারিত এখানে,
Click this link...

উপহার দেয়া, আবার সেই উপহার চুরি করে নিয়ে যাওয়া, আবার সেই লুন্ঠিত উপহার
ঢাকডোল পিটিয়ে ফেরত দেয়া কোন ধরনের মানসিকতা? আর তাতে কি বন্ধুত্ব বাড়ে?

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন