Powered By Blogger

শুক্রবার, ৭ মার্চ, ২০১৪

আমরা হবো তালেবান! বাংলা হবে আফগান! (অসম্ভব)


সময়টা যে কবে তা ঠিক মনে করতে পারছিনা। তবে ১৮/১৯ বছর পূর্বেকার ঘটনাই হবে বোধ হয়। ঢাকার রাস্তায় চলতে গিয়ে মাঝে মধ্যে দেখা যেতো ছোট খাটো মিছিল-মিছিলকারীরা শ্লোগান তুলছে-আমরা হবো তালেবান- বাংলা হবে আফগান। দেশবাসী তখনো সেইসব শ্লোগানকারীদেরকে কিংবা শ্লোগানকে মন্দ ভাবতে শিখেনি। বরং ধর্মপ্রান বাঙালীর কেমন যেনো নীরব এক সমর্থন ছিলো তালেবান শব্দটির ওপর। অনেক যুবক স্বপ্ন দেখতো তালেবান হবার জন্য। আবার কেউ কেউ প্রকাশ্য ঘোষনা দিয়ে আফগানিস্তান চলে গিয়েছিলো লালিত স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য। অনেক যুবক সেখানে যেতো-আবার যুদ্ধ ঠুদ্ধ করে ফেরতও আসতো। কেউ কেউ মারাও যেতো-আর তাদের আত্মীয় স্বজন গর্বভরে বলতো- তাদের ছেলে শহীদ হয়েছে। শহীদ পরিবার বিনা হিসাবে জান্নাতে যেতে পারবে- এই স্বপ্ন সুখ নিয়ে শত অভাবের মধ্যেও তারা এক ধরনের আত্মতৃপ্তি নিয়ে প্রাকৃতিক নিয়মে ভবলীলা সাঙ্গ করতো।
আফগানিস্তানে যারা যুদ্ধ করতে যেতো তারা নিজেদেরকে মুজাহিদ পরিচয় দিতো। আফগানিস্তানে যাওয়ারও বহু আগে বাঙালী যেতো সুদুর মধ্য প্রাচ্যে- প্যালেস্টাইনে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার জন্য হাজার হাজার বাঙালী মুসলমান প্যালেস্টাইনীদের কিংবদন্তী নেতা ইয়াসির আরাফাতের প্যালেস্টাইন আর্মি যার নাম ছিলো ঝটিকা বাহিনী-তাতে যোগ দিতো বেহেশত পাওয়ার জন্য। ইয়াসীর আরাফাত ছিলেন মার্কিনীদের জানি দুশমন। অন্যদিকে সোভিয়েত রাশিয়া তথা কম্যুনিস্টদের মানষপুত্র। ফলে বাংলাদেশের তৎকালীন শক্তিশালী বাম ঘরানার নাস্তিক রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দও সরলমনা ধর্মপ্রান বাঙালী যুবকদেরকে বেহেশত লাভের সফরে উৎসাহ ও উদ্দীপনা যোগাত। ফলে প্যালেস্টাইন আর্মির বিভিন্ন গ্র“প বা উপগ্র“পে বছরের পর বছর চাকুরী করার পর যখন মুসলমান যুবকরা গাজী উপাধী মনে মনে ধারণ করে বাংলাদেশে ফেরত আসলো তখন নাক উঁচু বুদ্ধিজীবিদের কেউ তাদেরকে জঙ্গী বলে গালি দিলো না।
আফগানিস্তানে গমনকারীদেরকেও গালি দেয়া হতো না। কারন আফগান তালেবানরা তখন দখলদার সোভিয়েত ইউনিয়নের বিরুদ্ধে প্রানপন লড়াই করে যাচ্ছিলো- সীমাহীন বীরত্ব আর অসাধারন সাহসিকতার সঙ্গে। তখনো তালেবানদের সঙ্গে আল কায়েদার সংযোগ স্থাপিত হয়নি। কিংবা মার্কিন সিআইএ বা পাকিস্তানী আই এস আই তখনো পর্যন্ত তালেবানদেরকে সমর্থন বা সাহায্য প্রদান শুরু করেনি। বিশ্বের প্রবল পরাক্রান্ত একটি রাষ্ট্রশক্তির ততোধিক পরাক্রান্ত ও সুসজ্জিত সেনাবাহিনীর আধুনিক মারনাস্ত্রের সম্মুখে ভূখা, নাঙ্গা, অশিক্ষিত এবং বলতে গেলে প্রায় নিরস্ত্র আফগানীরা অসীম সাহস নিয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলছে-এই খবর বিশ্ব মিডিয়ায় প্রচারিত হবার সঙ্গে সঙ্গে সারা দুনিয়ায় সাহসী মুসলমান যুবকদের রক্তে নাচন ধরা শুরু করলো। তারা স্বেচ্ছায় এবং দলে দলে তালেবান বাহিনীতে যোগ দেবার জন্য আফগানিস্তানের পথে রওয়ানা করলো। আমি যে সময়টার কথা বলছি তখন ঢাকার রাস্তায় প্রকাশ্যে মিছিল মিটিং করে ইসলাম পন্থী দলগুলো তালেবান বা আফগানিস্তানের মুজাহিদ হবার জন্য আহবান জানালো।
মোল্লা ওমর কিংবা ওসামা বিন লাদেন তখনো দৃশ্যপটে আসেননি। তালেবানদের তখনকার নেতা ছিলেন আহম্মদ শাহ মাসুদ এবং আব্দুর রশিদ দস্তাম। এই দুই জনেই আবার ছিলেন পরস্পরের শত্র“। ১৯৯৫ সাল পর্যন্ত তারা এককভাবে এবং নিজেদের চেষ্টায় লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলো। ১৯৯৬ সালে এসে সৌদি আরব, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান সম্মিলিত ভাবে তালেবানদের সাহায্য করতে এগিয়ে আসে। ফলে অতি অল্প সময়ের মধ্যে অর্থাৎ ১৯৯৬ সালের ২৭শে সেপ্টেম্বর তালেবানরা রাজধানী কাবুল দখল করে। আফগানিস্তানের নতুন নামকরন করা হয় ইসলামিক এমিরেট অব আফগানিস্তান।
মোল্লা ওমরের উত্থান, আল কায়েদা নামক সংগঠনটির সঙ্গে তার সম্পর্ক। ওসামা বিন লাদেনের আফগানিস্তান আগমন, মার্কিনীদের সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি এবং ঘটনা পরিক্রমায় নাইন ইলেভেন-টুইন টাওয়ার ধ্বংশ উপাখ্যান নিয়ে বহু কথা বলা যেতে পারে। যে তালেবান নিয়ে বিশ্বের মুক্তিকামী মুসলমানরা গর্ব করতো সে নামটির সঙ্গে মার্কিন মদদে সৃষ্ট আল কায়েদার বন্ধুত্ব এবং আর্ন্তজাতিক মিডিয়ার বহুমুখী প্রপাগান্ডায় এখন আর বাংলাদেশে কেউ তালেবান হতে চায় না। গত ৬/৭ বছর ধরেই তালেবান, আফগান এবং আল-কায়েদা শব্দগুলো এদেশে আর গর্বের সঙ্গে উচ্চারিত হয়না।
আজকের লিখার বিষয় বস্তু অবশ্য তালেবান বা আফগানিস্তান নয়। বিষয়বস্তু হলো- বাংলাদেশের মাটি, মানুষ এবং ভূ-রাজনৈতিক বৈশিষ্ট। ইদানিং লক্ষ্য করা যাচ্ছে যে- একটি মহল বা গোষ্ঠী প্রপাগান্ডা চালাচ্ছে যে, এই বুঝি বাংলাদেশের লোকজন সব তালেবান হয়ে গেলো। দেশটিও আফগানিস্তান হয়ে যাচ্ছে। দেশের নদীনালা শুকিয়ে উষর মরুভূমিতে পরিনত হবার পর হয়তো সেই মরুস্তানের বালুকা রাশি ফুড়ে শিলা নুড়ীর পাহাড় জেগে উঠবে। দেশের সবুজ বন-বনানীসব ধ্বংশ হয়ে যাবে। সুন্দর বন নামের ম্যানগ্রোভটি বিলীন হবার আগেই বাঘেরা সব পালিয়ে যাবে এবং কুমিরেরা সব মনের দুঃখে আত্মহত্যা করবে। আবহমান বাংলার ধান, গম আর বাঙ্গী চাষীরা সবকিছু বাদ দিয়ে আফিম চাষ শুরু করবে। সেই আফিম নিয়ে যুদ্ধ করতে করতে ভোতা বাঙালী হয়ে উঠবে যুদ্ধবাজ তালেবান।
তাই তোমরা কে কোথায় আছ-আসো! আমাদের নদী-নালা, বন-জঙ্গল, বাঘ, কুমীর আর কৃষকের কৃষিকে বাঁচাও-নচেৎ সত্যিই দেশটি আফগান হয়ে যাবে আর লোকজন হয়ে যাবে তালেবান- কোন কল্পনা বিলাসী কবি যদি এমন কথাও বলেন তবে আমি বলবো - অসম্ভব। বাংলা কখনো আফগান হবেনা। আর বাঙালী কখনো তালেবান হবে না। শতকোটি চেষ্টা করেও তা সম্ভব নয়। কেনো সম্ভব নয়- সেই কথাই হবে আজকের লেখার প্রতিপাদ্য বিষয়।
প্রথমেই বলে নেই আফগানিস্তান যায়গাটি আসলে কেমন। কেনই বা ঐ ভূমি সুলতান মাহমুদ, বাবুর, শেরশাহ এবং তৈমুর লংদের মতো মহাবীর পয়দা করে! আবার কেনই বা ঐ ভূমিতে কোন উদ্ধত পা রাখতে সাহস পাননি চেঙ্গিস খান, হালাকু খান, আলেকজান্ডার কিংবা জুলিয়াস সিজারের মতো দুনিয়া কাঁপানো মহা বীরেরা। কেনই বা অনাদীকাল থেকে দেশটি স্বাধীনতা ভোগ করে আসছে! কিংবা বিশ্বের কোন পরাশক্তি ইতিহাসের যে কোন সন্ধিক্ষনে কেনো জাতিটিকে পরাভূত করতে পারেনি। তাবৎ দুনিয়ার জ্ঞানী গুনী ব্যক্তিরা শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে আফগানিস্তান নিয়ে গবেষনা করে আসছে।
প্রায় পঞ্চাশ হাজার বছর ধরে আফগানিস্তান এলাকায় লোকজন বসবাস করে আসছে। দেশটির রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক সভ্যতাও পৃথিবীর অন্য যে কোন প্রান্তের তুলনায় কোন মতেই পেছানো নয়। ভূ-মধ্য সাগরের তীরবর্তী দেশগুলোর সঙ্গে চীন দেশের চলাচলের ঐতিহাসিক সিল্ক রোডটি গেটওয়ে আফগানিস্তানের মধ্য দিয়ে চলে গেছে। হিন্দুকুশ পর্বতমালা, ইন্দুস উপত্যাকা, ভারতে ঢোকার একমাত্র প্রবেশপথ এবং মধ্যপ্রাচ্য ও মধ্য এশিয়ার যাতায়াতের একমাত্র মাধ্যম হলো আফগানিস্তান। ফলে সভ্যতার সেই আদিমকাল থেকেই আফগান জাতি কিছু না থাকা সত্বেও নিজেদেরকে ধনী এবং প্রভাবশালী মনে করতো। মরুভূমির উষ্ণ বাতাস, বরফ আচ্ছাদিত পাহাড়ের হাড় কাঁপানো বাতাস আর রুক্ষ শিলাময় পাহাড়ের ধুলিময় বাতাসের- ত্রিমুখী শক্তি আফগান জাতিকে করে তুলেছে দূর্বার, দুরন্ত আর দুঃসাহসী।
অন্যদিকে গাঙ্গেয় ব দ্বীপের বাংলা নামক ভূ-খন্ডের আদ্র এবং নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়া এ জাতিকে করে তুলেছে আরাম প্রিয়, গল্পবাজ এবং নানা রকম ফাজলামো মূলক কর্মকান্ডের মহা পন্ডিত। আফগান দরবারে বসে যখন মহাকবি ফেরদৌসী শাহনামা রচনা করেছেন তখন আমাদের দেশে কি হয়েছে। এই বঙ্গে কবে কোন বীর পয়দা হয়ে রাজত্ব করেছিলো তা আজ অবধি কেউ খুঁজে পায়নি। আমাদের বঙ্গ সন্তানেরা সমূদ্র পাড়ি দিয়ে অন্য দেশ জয় করবে একথা কোন কালে কেউ কল্পনা করেনি। আমাদের সাহিত্যের নায়কের নাম মদন কুমার- নায়িকার নাম মধুবালা। নায়ক জন্মগত ভাবে অটিষ্টিক এবং বদ্ধ উম্মাদ। আর নায়িকা হলো সমুদ্রের ওপাড়ের স্বপ্নের দেশের রাজকন্যা। নায়ক দুনিয়ার কোন শক্তি বা যন্ত্রকৌশলের সাহায্য নিয়ে নায়িকার দেশে যেতে পারেনা। পরীস্তান থেকে পরীরা এসে উম্মাদ নায়ককে নায়িকার কাছে নিয়ে যায়। কোন রকম আনুষ্ঠানিকতা, পিতামাতার অনুমতি কিংবা সমাজের স্বাভাবিক ভদ্রতাটুকু না দেখিয়ে নায়ক নায়িকা শয়ন ঘরে মালা বদল করে বিয়ে থা করে রতিক্রিয়া আরম্ভ করে। অলস বাঙালী হেলেনকে পাওয়ার জন্য যুবরাজ প্যারিস যে কষ্ট করেছিলো কিংবা তাকে উদ্ধার করার জন্য যে কষ্টসাধ্য যুদ্ধ করা হয়েছিলো তা করতে একেবারেই নারাজ। তারা স্বপ্নে রাজকন্যার সঙ্গে রমন করবে, মনে মনে কলা খাবে এবং ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে রসগোল্লা খাবে। আর সারাদিন ফন্দি ফিকির করবে কিভাবে প্রতিপক্ষকে ঠকানো যায় কিংবা প্রতারনার মাধ্যমে প্রতিপক্ষের অর্জিত সম্পত্তি কুক্ষিগত করা যায়!
বাঙালীর অদ্ভূত সব স্বভাব আর ভীরুতা নিয়ে নানা রকম গল্প উপাখ্যান রচিত হয়েছে যুগে যুগে। এদেশের রাজা বাদশারা যে কতবড় নাদান আর বেকুব ছিলো তা গোপাল ভাঁড়ের কাহিনী পড়লে জানা যায়। এদেশের জনগন যে কতবড় ভীরু আর কাপুরুষ ছিলো তা ঐতিহাসিক মিনহাজুস সিরাজের লেখায় পাওয়া যায়। এদেশের জনগন জর্দা, সুপারী আর চুন দিয়ে পান খায়। গোসলের আগে নাভী এবং ভূড়ির ওপর আচ্ছা করে সরিষার তেল মাখে। এরা তাদের দেবী সীতাকে উদ্ধার করার জন্য হনুমানের সাহায্য গ্রহন করে। অন্যদিকে অসুরকে বধ করার জন্য দশহাত বিশিষ্ট নারী দেবী দূর্গার আরাধনা করে।
বাঙালীর ঐতিহাসিক যে সকল বীর কিংবা দেবতার ছবি বা মূর্তি আজ পর্যন্ত দেখা গিয়েছে তারা সবাই ছিলো মেদ বহুল শরীরের অধিকারী। বিশাল পেট, সারা শরীরে থলথলে চর্বি আর পরনে ধুতি, হাফ প্যান্ট কিংবা নিদেন পক্ষে পাজামা। কোন কোন বীরকে দেখা যায় সম্পূর্ন খালি গায়ে নেংটি পরা অবস্থায়। আজ থেকে আড়াই হাজার বছর আগে গ্রীক, রোমান সৈন্যরা যখন সামরিক পোশাক পরে আধুনিক যুদ্ধাস্ত্র নিয়ে বিশ্বজয় করতো তখন এদেশীয় বীরেরা যুদ্ধ যাত্রার পূর্বে হোম যজ্ঞ করতো এবং ভূত প্রেতের সাহায্য কামনা করতো। কোন বাঙালী রাজ পুরুষ বিদেশী দখলদার বাহিনীকে যুদ্ধে পরাভূত করে রাজত্ব কায়েম করেছে- এমন সুসংবাদ ঐতিহাসিকগন লিপিবদ্ধ করতে পারেননি। বরং বিদেশ থেকে বীরের বেশে এদেশে এসে অনেকেই ভেড়া বনে গেছেন- এমন উদাহরন দেয়া যাবে শত শত।
আমার এতো কথা বলার অর্থ হলো- হাজার বছরের মন এবং মনশীলতা নিয়ে বাঙালী কখনোই তালেবান হতে পারবে না। কারন তালেবান হবার মতো মুরদ কিংবা ইচ্ছাশক্তি কিংবা আত্মত্যাগ এই ভূখন্ডে কেউ কখনো দেখাতে পারেনি। ঢাকার রাস্তায় রিকসার টায়ার পাংচার হলে লোকজন দৌড় মারে। ট্রাকের চাকা ফেটে দুড়–ম করে আওয়াজ হলে লোকজন ফিট পড়ে। কোন রাস্তায় যদি বিদ্যুতের একটি ট্রান্স ফরমার ফেটে যায়- ঐ এলাকার অনেক কাক ভয়ের চোটে পায়খানা করে দেয়- সেই দেশে কিভাবে তালেবান হবে তা আমার মাথায় ঢোকেনা।
আমরা সেই জাতি- যারা কমেডির চেয়ে ট্রাজেডী ভালোবাসি। বাঙালীকে বলা হয় রঙ্গ প্রিয়। কিন্তু আসলে তারা কান্না প্রিয়। কোন নাটক সিনেমায় বা যাত্রা পালায় পর্যাপ্ত কান্নার দৃশ্য না থাকলে তা কখনোই দর্শক প্রিয়তা পায়না। যে নায়ক বা নায়িকা যতো বেশী কাঁদতে পারে এবং মানুষের জুলুম নীরবে সৈহ্য করতে পারে আমাদের জনমত তাকেই জনপ্রিয় করে তোলে। কারো বিশ্বাস না হলে মীনা কুমারী, সুচিত্রা সেন কিংবা বাংলাদেশের শাবানার সিনেমাগুলো আরো একবার দেখে নিতে পারেন। যে দেশের পথে ঘাটে ধোড়া সাপ, কুইচা, কেঁচো গিজ গিজ করে; কিংবা যে দেশের জনগন মশার যন্ত্রনায় দুদন্ড চুপচাপ বসতে পারে না অথবা যে দেশের বিশির ভাগ লোক গুড়া কৃমির আক্রমনের শিকার - সেই ভূ-খন্ড কিভাবে আফগান হবে? হতে পারেনা এবং পারবেও না। কারন আফগানিস্তানের তালেবানদেরকে অস্ত্র হাতে শত্র“র বিরুদ্ধে লড়াই করতে হয় জীবন বাজি রেখে, দিনের পর দিন, বা মাসের পর মাস- আবার কখনো স্ত্রী পুত্র পরিজন রেখে বছরের পর বছর ধরে। পেটে খাবার থাকে না, পরনে কাপড় থাকেনা কিন্তু আত্ম মর্যাদায় মস্তিষ্ক টন টন করতে থাকে। শত্র“কে ঘায়েল করার জন্য তারা রুক্ষ পাহাড়ের চুড়ায় বসে থাকে সীমান্ত ঈগলের মতো। কখনো পাহাড় থেকে লাফিয়ে পড়ে জীবন দেয় আবার কখনো বুকে গ্রেনেড বেঁধে ঝাপিয়ে পড়ে শত্র“ শিবিরে। সেই দেশের লোকদের পেটে যদি আমাদের মতো গন্ডগোল থাকতো তাহলে যুদ্ধ শুরু করার আগে বলতো- দাঁড়াও, একটু অপেক্ষা কর- জায়গামতো একটু খাউজাইয়্যা নেই।
এদেশের লোকজনের সাহস শক্তির একটি ক্ষুদ্র ঘটনা বর্ননা করে আজকের লেখা শেষ করবো। গ্রামের নাম কুসুমপুর। পদ্মা পাড়ের কুসুমপুর গ্রামে গফুর পাহ্লোয়ানের নাম ডাকে ভূত প্রেত পর্যন্ত পালিয়ে যায়। মস্তবড় বীর। চার চারটে বউ-আর দুলাল নামের একটি মর্দা ঘোড়ার মালিক গফুর পাহলোয়ান রাস্তায় বের হলে লোকজন সব ভয়ে থর থর করে কাঁপতে শুরু করে। দুলালের পীঠে চড়ে গফুর মর্দ হাডুডু খেলতে যায়-দশ-বিশটা গ্রামে কেউ তার সঙ্গে হাডুডু খেলায় পেরে উঠেনা। তার যতো বীরত্ব খেলার মাঠে এবং ঘরের মধ্যে চার চারটা বউয়ের সঙ্গে। বউ পেটানো তার জন্মগত অভ্যাস, ইদানিংকালে মনে হচ্ছে বউ পিটিয়ে সে খুব আনন্দ লাভ করে। আর গফুরের বউগুলোও ভারী বজ্জাত। গফুর মারতে থাকে আর তারা চোপা চালাতে থাকে- সেকি গালিরে বাবা- মরা মানুষ জিন্দা হবার উপক্রম!
চার বউয়ের মধ্যে আবার ভারী মিল। তারা একসঙ্গে গান গায় আর পান খায়। এক রঙ্গের শাড়ী পরে মেলায় যায় এবং সকলে মিলে প্রতিপক্ষের সঙ্গে গলা মিলিয়ে ঝগড়া করে। প্রতিপক্ষ বলতে পাশের বাড়ীর হাকির দুই বউ। হাকি মিয়া ঘোড়ার গাড়ী চালায়- দুইটি ঘোড়াই মাদি। গফুর মিয়ার চার বউ চুপি চুপি পরামর্শ করে- কিভাবে হাকির বউদেরকে অপদস্ত করা যায়। অন্যদিকে চারজনে মিলে গফুর মিয়াকে ছ্যাঁচা দেয়ার বহু চক্রান্ত তারা বহুদিন করেছে- কিন্তু স্বামীর সামনে পড়লে সবারই শুরু হয় হাটু কাঁপুনী, গফুর মিয়ার হয়েছে মহা যন্ত্রনা- একজনকে মারলে চারজন মিলে কান্নাকাটি করে আর তার মরা বাপ মা তুলে যাচ্ছেতাই গালাগালি করে। সেইসব গালি শুনে পাশের বাড়ির হাকি আর তার বউয়েরা দাঁত বের করে ভ্যাটকাইয়া ভ্যাটকাইয়া হাসতে থাকে।
এই ভাবেই চলছিলো বহুদিন। কিন্তু গন্ডগোল বাঁধলো সেইদিন যেদিন হাকি একটা মর্দা ঘোড়া কিনে আনলো এবং ঘোড়ার নাম রাখলো দুলাল। গফুর পাহ্লোয়ানের চার বউ কোমরে কাপড় বেঁধে ঝগড়া করতে গেলো হাকির বউদের সঙ্গে। কার ঘোড়া কত বড় এই নিয়ে ঝগড়া। কোন ঘোড়ার লেজ বড়, কোনটার শরীরে শক্তি বেশি ইত্যাদি নিয়ে বিতর্ক করতে করতে চলে এলো ঘোড়াটির বিশেষ অঙ্গ পর্যন্ত। সেদিন হাকি এবং গফুর দুজনেই বাড়ীতে ছিলো। এক পর্যায়ে তারা নিজ নিজ বউদের পক্ষে ঝগড়ায় যোগ দেবার জন্য ঘর থেকে বের হয়ে এলো। হাকি চিকন চাকন পাতলা মানুষ-তার শরীরে তেমন শক্তি না থাকলেও চোপা খুব খারাপ। অন্যদিকে তার বউরা তুলনামূলক সুন্দরী এবং মিষ্ট ভাষী। হাকি যখন দেখলো- বউরা পারছেনা তখন সে গফুর পাহ্লোয়ানের বউদের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে চোপা চালাতে লাগলো। পাড়ার দুষ্ট ছেলেরা দলে দলে এগিয়ে এলো ঝগড়া শোনার জন্য। তারা ভারী মজা পেলো এবং ঝগড়া যাতে বন্ধ না হয় সেজন্য কেউ একজন জোরে জোরে সিকা নাড়াতে লাগলো।
গফুর মিয়া তেমন কথাবার্তা বলেনা। হাকি তাকে আজীবন যমের মতো ভয় পেতো। আজ হাকির বাড়াবাড়ি দেখে তার মাথায় রক্ত উঠে গেলো। সে হাকিকে লক্ষ্য করে মারলো জোরে এক ঘুষি। হাকি শরীরটা বাঁকা করে ঘুষি থেকে রক্ষা পেলো বটে কিন্তু ভয়ে তার গলা শুকিয়ে গেলো। সে মনে করলো তার শরীরে বোধ হয় ঘুষি লেগেছে। সে সঙ্গে সঙ্গে ফিট পড়লো- বউরা সব তার গলা ধরে কান্না কাটি শুরু করলো।
ঘটনার আকস্মিকতায় গফুর পাহ্লোয়ান কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে গেলো। তার বউরা ডরে চোয়া চোয়া করে মিহিসুরে কেঁদে উঠলো। গফুর বললো- এই মাগীরা কান্না থামা। এদিকে আয়, তোরা সবাই মিলে আমারে মারতে থাক আর আমি ফিট পড়ার ভান করি। তোরা তখন কান্নাকাটি করে বলবি-হাকি আর তার বউরা আমারে একলা পেয়ে মেরে অজ্ঞান করে ফেলেছে । গফুর পাহলোয়ানের বউরা কিসে কি বুঝলো- আল্লায়ই জানে। ঘর থেকে চারটা মুগুর এনে বেধড়ক পেটাতে শুরু করলো সাধের নাগরকে। ২/৩ মিনিট পর গফুর সত্যিই মুর্ছা গেলো। বউরা বুঝলো - সত্যিই সর্বনাশ হয়ে গেছে-আর অমনি শুরু করলো অতিস্বরে আহাজারি।


কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন