Powered By Blogger

মঙ্গলবার, ৬ নভেম্বর, ২০১২

‘মন্দের ভালো’ বারাক ওবামা

সিএনএনসহ বিভিন্ন প্রচারমাধ্যমে এ কথা অবিরাম প্রচারিত হচ্ছে যে মার্কিন জনগণ ভোট দিয়ে তাঁদের দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করবেন ঠিক, তবে এই নির্বাচন সারা দুনিয়ার জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। এ কথা নিয়ে কোনো বিতর্ক নেই যে বিশ্বের সবচেয়ে ক্ষমতাধর এই দেশে রাষ্ট্র পরিচালনা বা পররাষ্ট্রসম্পর্কিত যেকোনো নীতি বা সিদ্ধান্ত বিশ্বের অন্যান্য অঞ্চলের মানুষের দৈনন্দিন জীবনকেও প্রভাবিত করতে সক্ষম। কিন্তু এই নির্বাচন কি আসলেই কোনো পরিবর্তন আনতে পারবে? বুশ থেকে ওবামা পরিবর্তনে বিশ্বে মার্কিন ভূমিকার কি কোনো পরিবর্তন এসেছে? ক্ষমতার অন্যান্য স্তম্ভ অপরিবর্তিত রেখে প্রেসিডেন্ট পরিবর্তনে কি ঘরে-বাইরে কোনো গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন সম্ভব?
নির্বাচন সামনে রেখে ওবামা-রমনি বিতর্ক ঘিরে মাসাধিক কাল ধরে যুক্তরাষ্ট্রের মানুষের মধ্যে উত্তেজনা ছিল। ব্যাপকভাবে জনগণের বিভিন্ন অংশ এই বিতর্ক দেখেছেন। ওই সময়ে আমার যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন অঞ্চলে যাওয়ার এবং নানা পেশার অনেকের কথা শোনার সুযোগ হয়েছিল। ওবামা-রমনি বিতর্কের প্রথমটি আমি শুনেছি সানফ্রানসিসকোতে। ওয়াশিংটনে শুনেছি ওবামা-রমনি দ্বিতীয় দফা বিতর্ক, আর বিদেন-রায়ান বিতর্ক শুনেছি নিউইয়র্কে। তৃতীয় বিতর্কের সময় ছিলাম ফিরতি পথে। প্রথম বিতর্ক শোনাকালে আমার প্রতি এই প্রশ্ন নিক্ষেপ করেছিলেন সেখানে উপস্থিত মার্কিনরা, এই নির্বাচন বাংলাদেশের জন্য কী প্রভাব ফেলতে পারে? কে নির্বাচিত হলে বাংলাদেশের জন্য ভালো হবে? উত্তর আমি দিয়েছিলাম কয়েকটি উদাহরণ দিয়ে, সেটা পরে বলছি। সঙ্গে তাঁদেরও আমি একটি প্রশ্ন করেছিলাম, ‘মার্কিন নির্বাচন সম্পর্কে বার্ট্রান্ড রাসেলের কথার সঙ্গে কি তোমরা একমত?’ রাসেলের কথাটি তাঁদের জানা ছিল না। বললাম, যা রাসেল বলেছিলেন, ‘মার্কিন জনগণের ট্র্যাজেডি হলো, তারা যাদের নির্বাচিত করে তারা দেশ চালায় না, আর দেশ যারা চালায় তাদের নির্বাচিত করার কোনো সুযোগ মার্কিন নাগরিকদের নেই।’ কারা তারা? এরা বৃহৎ সব বহুজাতিক সংস্থা আর এদের সহযোগী অস্ত্র ব্যবসায়ী, পেন্টাগনসহ মিলিটারি এস্টাবলিশমেন্ট—সব মিলিয়ে মিলিটারি ইন্ডাস্ট্রিয়াল কমপ্লেক্স। গত মাসে ম্যাসাচুসেটস বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘হু ওউনস দ্য ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক বক্তব্যে এমআইটির প্রফেসর নোয়াম চমস্কিও একই কথা বললেন। এ কারণেই চমস্কি বলেন, গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলোতে এদের অবস্থানে কার্যত কোনো পার্থক্য দেখা যাচ্ছে না। এই দুইয়ের মধ্যে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত রাখতে সব আয়োজন শক্তিশালী।
নির্বাচনের সব কটি বিতর্কেই বেকারত্ব, ঋণগ্রস্ততা, স্বাস্থ্যসুবিধার সংকট, বৈষম্য, যুদ্ধব্যয়—এসব প্রসঙ্গ এসেছে। এসব বিতর্কেই উঠে এসেছে কিছু ভয়ংকর চিত্র; পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষমতাশালী ও সম্পদশালী দুনিয়ার অনেক অঞ্চলের সম্পদ লুণ্ঠনকারী দেশের জন্য যা অবিশ্বাস্য মনে হবে। ক্ষমতার শীর্ষে অবস্থানকারী এই ব্যক্তিরাই বললেন, মার্কিন দেশে এখন প্রায় তিন কোটি মানুষ কখনো না কখনো অনাহারে থাকে। ৪ দশমিক ৭ কোটি মানুষ চিকিৎসা বিমার বাইরে, মানে চিকিৎসাসেবা নিতে অক্ষম। সমান কাজ হলেও নারীর জন্য মজুরি পুরুষের শতকরা ৭০ ভাগ। জিনিসপত্রের দাম বাড়তি। বেকারত্বের বোঝা কমেনি। নির্বাচনের আগে আগে সরকারি তথ্যেই দেখা যাচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রের ৪ দশমিক ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে। শিশুদের প্রতি পাঁচজনের একজন দারিদ্র্যসীমার নিচে।
এই বিশাল অনাহারী মানুষের জন্য কি এই সম্পদশালী দেশে সম্পদের অভাব? এটা ঠিক যে অনাহারী মানুষের খাদ্য সরবরাহের জন্য ফুড স্ট্যাম্পসহ নানা ব্যবস্থা আছে। এর জন্য বছরে বছরে খরচ বেড়েছে। ফুড স্ট্যাম্পসহ গরিবদের সমর্থনের নানা খাতে ব্যয় এখন প্রায় ৬০ বিলিয়ন (এক বিলিয়ন সমান ১০০ কোটি) মার্কিন ডলার, যা কমানোর চাপ আছে। কিন্তু এই দেশেরই কারাগারের পেছনে এখন বার্ষিক ব্যয় ৮০ বিলিয়ন ডলার। বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রই এখন বৃহত্তম কারাগার, অর্থাৎ বিশ্বে যুক্তরাষ্ট্রেই সবচেয়ে বেশিসংখ্যক মানুষ কারাগারে বাস করে। ১ নভেম্বর আল-জাজিরায় প্রদর্শিত এক তথ্যচিত্রে একজন মার্কিন গবেষক বলছিলেন, ‘বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে যত কৃষ্ণাঙ্গ কারাগারে আছে, সেই সংখ্যা দাসবাণিজ্যকালে যুক্তরাষ্ট্রে সর্বোচ্চসংখ্যক কৃষ্ণাঙ্গ দাসদের চেয়ে বেশি।’ আর এই দেশেই ৭০০ বিলিয়ন ডলার প্রতিবছর খরচ হয় অন্য দেশ দখল, গোয়েন্দাবৃত্তি আর গণহত্যায়। এই ব্যয়ে লাভবান হয় শতকরা ১ ভাগেরও কম জনসংখ্যার ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠী, তেল, অস্ত্র নির্মাণসহ বিভিন্ন কোম্পানি। নানা রকম ভর্তুকি, করসুবিধা, নিয়ন্ত্রণহীন ক্ষতিকর বিনিয়োগ ও জালিয়াতি, দেশে দেশে অবাধ তৎপরতা এদের উচ্চ আয়ের উৎস।
সরকারি হিসাবই বলে, এই শতকরা ১ ভাগের আয় দেশের আয়ের শতকরা প্রায় ২৫ ভাগ, আর শতকরা প্রায় ৪০ ভাগ সম্পদ তাদের দখলে। রাসেলের মতো উদারনীতিক দার্শনিক এদের ক্ষমতার প্রতিই ইঙ্গিত করেছিলেন। এদের খাঁই পূরণ করতে গিয়ে বিশ্ব এখন স্থায়ী সন্ত্রাসের ভূমি আর যুক্তরাষ্ট্র নিজেই সবচেয়ে বড় ঋণগ্রস্ত দেশ। এখন মার্কিন ঋণ প্রায় তার বার্ষিক জিডিপির সমান। ঋণের মাত্রা যা আগে নির্দিষ্ট করা ছিল, কিছুদিন আগেই কংগ্রেস তা বৃদ্ধি করেছে। বৈষম্যের মাত্রাও এখন আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় বেশি।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মাত্র কদিন আগে নিউইয়র্ক ও নিউজার্সির অঞ্চলের কয়েক কোটি মানুষ ঘূর্ণিঝড় স্যান্ডির আঘাতে বিপদগ্রস্ত হলো। স্থায়ী ও নিয়মিত বেতন বা মজুরি পান, তার তুলনায় যুক্তরাষ্ট্রে অপ্রাতিষ্ঠানিক খাতে নিয়োজিত মানুষের সংখ্যা অনেক বেশি। অস্থায়ী, খণ্ডকালীনও অনেকে। স্বাস্থ্যবিমাহীন, খাদ্য, আশ্রয় ও চিকিৎসার সমস্যায় যাঁরা আগেই ছিলেন, তাঁদের নাজুক অবস্থা আরও বাড়ল। নিউ অরলিন্সে বুশ আমলের ঘটা ক্যাটরিনার ক্ষত অনেকের জন্য এখনো পুরোপুরি সারেনি। লক্ষাধিক মানুষ তখন গৃহহীন হয়েছে। এই দরিদ্র মানুষের জন্য কোনো জাতীয় পরিকল্পনা তখন দেখা যায়নি। ঋণের বোঝা বেড়েছে তাদের। কিন্তু পুনর্গঠনের নামে ভাইস প্রেসিডেন্ট ডিক চেনির হেলিবার্টনসহ কয়েকটি কোম্পানি ঠিকই বিলিয়ন ডলার কন্ট্রাক্ট পেয়েছে।
মার্কিন আগ্রহী শ্রোতাদের প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে আমাদের কয়েকটি দৃষ্টান্ত তুলে ধরলাম। ২০০১ সালের ১৫ মে ঢাকায় এক বক্তব্যে তৎকালীন মার্কিন রাষ্ট্রদূত মেরি অ্যান পিটার্স কয়েক মাস পরে অনুষ্ঠেয় বাংলাদেশের নির্বাচনে যাঁরা ক্ষমতায় আসবেন, তাঁদের প্রথম ১০০ দিনে করণীয় ঠিক করে দিয়েছিলেন। এর মধ্যে ছিল মার্কিন কোম্পানি ইউনোকলের প্রস্তাব অনুযায়ী ভারতে গ্যাস রপ্তানি ও চট্টগ্রাম বন্দরকে মার্কিন এক কোম্পানির হাতে ২০০ বছরের জন্য ইজারা দেওয়া। সেটা ছিল জুনিয়র বুশ আমল। সেই বুশ আমলের আট বছর এই একই ধারায় আরও তৎপরতা চলেছে। এরপর ২০০৮ সালে শুরু হলো ওবামা আমল। উইকিলিকস সূত্র পরিষ্কার করেছে, এই আমলের রাষ্ট্রদূত জেমস মরিয়ার্টি জ্বালানি উপদেষ্টাকে বিশেষভাবে ধরেছেন কনোকোফিলিপসের সঙ্গে গ্যাস রপ্তানিমুখী চুক্তি সম্পাদন করতে। একই সঙ্গে তিনি বিশেষ জোর দিয়েছেন, এশিয়া এনার্জির উন্মুক্ত খনি অতিশিগগিরই অনুমতি দেওয়ার জন্য। লন্ডনে তালিকাভুক্ত ও জনপ্রতিরোধের মুখে বিতাড়িত একটি অনভিজ্ঞ কোম্পানির মাধ্যমে মাটি-পানি-মানুষবিনাশী একটি ধ্বংসযজ্ঞের প্রকল্প বাস্তবায়নে মার্কিন রাষ্ট্রদূতের কেন এত আগ্রহ? উত্তর আসে উইকিলিকসে পাওয়া তাঁর বক্তব্য থেকেই। তিনি বলেছেন, এতে তাদের শতকরা ৬০ ভাগ স্বার্থ আছে। এটি ছিল ২০০৯ সালের জুলাই মাসের ঘটনা। তিনি গেলেন। এরপর বর্তমান রাষ্ট্রদূত ড্যান মজীনা গত কিছুদিনে অনেক বক্তব্য দিয়েছেন। কয়েক দফায় তিনি জোর দিয়ে বলেছেন, অবশ্যই ফুলবাড়ী উন্মুক্ত খনির প্রকল্প তাড়াতাড়ি চালু করতে হবে। বঙ্গোপসাগরের গ্যাস ব্লকসহ আরও সর্বনাশা চুক্তি করাসহ তিনি বাংলাদেশ থেকে গ্যাস, কয়লা এমনকি বিদ্যুৎও রপ্তানির ওপর জোর দিয়েছেন (ডেইলি সান, ১২ অক্টোবর ২০১২)। নিরাপত্তার নামে নানা সামরিক চুক্তির বিষয়েও একই ধারাবাহিকতা দেখা যায়। ‘মুক্ত বাজার অর্থনীতির’ সব নিয়মনীতি ভঙ্গ করে মার্কিন সব সরকারই বাংলাদেশের গার্মেন্টস পণ্য আমদানির ওপর উচ্চ শুল্কহার বসিয়ে রেখেছে। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্র থেকে ‘বিদেশি সাহায্য’ নামে যে পরিমাণ অর্থ আসে, তার চার গুণ তারা আয় করে বাংলাদেশের গার্মেন্টসের ওপর আরোপিত উচ্চহারের শুল্ক থেকে। এসব দৃষ্টান্ত দেখিয়েই বললাম, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ফলাফল যা-ই হোক, বাংলাদেশের মতো দেশগুলোতে কোনো পার্থক্য আমরা টের পাই না। আমার কথা শুনে শ্রোতাদের মধ্য থেকেই একজন বললেন, এসব দূতাবাস যার করের পয়সায় চলে, সেই মার্কিন জনগণের প্রতিনিধিত্ব তারা করে না। তারা আসলে বৃহৎ করপোরেট স্বার্থ নিয়ে ব্যস্ত থাকে!
উপস্থিত অধিকাংশই ছিলেন ‘আমরা ৯৯ শতাংশ’ আন্দোলনের অংশীদার।
মার্কিন জনগণ ওবামার ওপর অনেক ভরসা করেছিলেন। পরিবর্তনের কথা বলেই তিনি প্রথম দফায় ক্ষমতায় এসেছিলেন। নির্বাচনের আগে আগে তাঁর লেখা অডাসিটি অব হোপ গ্রন্থটি তরুণদের মধ্যেও আশার সঞ্চার করেছিল। মানুষ তখন বুশ-চেনি-রামসফেল্ড-রাইস চক্রের হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য মরিয়া। ক্ষমতায় এসেছিলেন ওবামা। তিনি পরিবর্তন করতে পারেননি, নিজেই পরিবর্তিত হয়েছেন মেশিনের সঙ্গে খাপ খাওয়ানোর জন্য। যতটুকু ইচ্ছা প্রকাশ করেছেন, তাতেই রিপাবলিকানদের প্রচারণায় তিনি বামপন্থী! এবারে বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের সঙ্গে কথা বলে দেখেছি, ওবামার এককালীন সমর্থকেরা সাধারণভাবে হতাশ, কিন্তু রমনির ভয়েই শেষ পর্যন্ত তাঁদের ওবামাকেই ভোট দিতে হবে। কেননা, দেশের ভেতরে ওবামা কোনো উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন না আনতে পারলেও রমনি যে রিপাবলিকানদের প্রতিনিধিত্ব করেন, তাদের নীতি ও কর্মসূচি ধনিক শ্রেণীর পক্ষে। শ্রমিক, মধ্যবিত্ত, অশ্বেতাঙ্গ, ইমিগ্র্যান্ট ও নারীর জন্য আরও প্রতিকূল। সেটাই ব্যর্থতা বা প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ সত্ত্বেও ওবামার প্রধান ভরসা।
শিল্পায়িত বিশ্বের মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রেই শ্রমজীবী মানুষ সবচেয়ে অসংগঠিত। অভিবাসীদের দেশ হওয়ার কারণে বিভক্তি বজায় রাখা খুব সহজ। শতকরা মাত্র সাতজন সেখানে ইউনিয়নভুক্ত। বাকি সবাই অসংগঠিত। নানা ধরনের শ্রমিকেরা সংখ্যায় গরিষ্ঠ হলেও তাঁদের অস্তিত্ব ঢেকে ফেলার চেষ্টাই বরাবর সফল হয়েছে। মে দিবস তৈরি হয়েছিল এই যুক্তরাষ্ট্রেরই শিকাগো শহরে, অথচ মধ্যপ্রাচ্যের রাজতন্ত্রশাসিত দেশগুলোর বাইরে যুক্তরাষ্ট্রই হচ্ছে উল্লেখযোগ্য দেশ, যেখানে মে দিবস সরকারিভাবে স্বীকৃত নয়। শ্রমিকদের লড়াইয়ের ধারাবাহিকতা ভুলিয়ে দেওয়ার জন্যই এই আয়োজন। মিলান কুন্ডেরার ভাষায়, মানুষের লড়াই আসলে ভুলিয়ে দেওয়ার জাল থেকে নিজেকে উদ্ধার করা। সে জন্যই যুক্তরাষ্ট্রে ‘আমরা ৯৯ শতাংশ’ নামে নতুন পরিচয়ের উদ্ভব হয়েছে। রাজনৈতিক শক্তি হিসেবে তা এখনো স্পষ্ট রূপ নেয়নি। তার ফলে নির্বাচনের নামে ১ শতাংশ ধনপতিদের মুখপাত্র বাছাইয়ের এই বছরের পর্বেও মানুষের সামনে অপশন বা বাছাই করার সুযোগ সীমিত—‘বিগ অর বিগার এভিল’। এই অসহায়ত্ব বাংলাদেশের মানুষকে বুঝিয়ে বলতে হবে না।
৩ নভেম্বর ২০১২
আনু মুহাম্মদ: অর্থনীতিবিদ ও অধ্যাপক, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়।

বুধবার, ১৯ সেপ্টেম্বর, ২০১২

দ্য লোডশেডিং রিটার্নস

রতিবছর আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসে লোডশেডিং। লোডশেডিংকে আমরা আর হারাতে চাই না। হূদয়গ্রাহী পারফরম্যান্সের জন্য একে ‘গোল্ড মেডেল’ দেওয়া উচিত। আমাদের শোবার ঘরে ‘নিরাপত্তা’ ঢুকতে না পারলেও ‘লোডশেডিং’ ঠিকই ঢুকে বসে থাকে! সময় মেনে, নিয়ম মেনে আসা-যাওয়া করে। জাতীয় জীবনে তার অবদান কতটা awesome, তা জানাতেই মোমবাতির আলোয় বসে এই লেখা লিখছি।
এ যুগে ‘অ্যানালগ সামাজিকতা’ বিরল বস্তু। কিন্তু লোডশেডিংয়ের কল্যাণে তা একেবারে বিলুপ্ত হয়ে যায়নি। লোডশেডিংয়ের সময় গরমে ‘হিট স্ট্রোকের’ ভয়ে রাত-বিরাতে অনেকে বাসা থেকে বের হয়। ফলে প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা হয়ে যায়। আবার বসতবাড়ির চারপাশে এই লোকসমাগম হওয়ায় চোর-ছেঁচড়দের উৎপাত কমে গেছে। পরিণামে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি হচ্ছে। বিদ্যুৎ চলে গেলে কেউ কেউ চলে যায় ছাদে। জ্যোৎস্নার আলো খেতে খেতে অণুকাব্য রচনা করে। এভাবে সামষ্টিক সুকুমারবৃত্তির চর্চা হওয়ায় ‘লোডশেডিংয়ের রাজ্যে পৃথিবী পদ্যময়’ হয়ে ওঠে!
ছুটির দিনেও লোডশেডিংয়ের কর্মতৎপরতা আমাদের আবেগাপ্লুত করে! এ থেকে আমরা কর্মঠ হওয়ার শিক্ষা পাই। কিন্তু এতটুকু শিক্ষা দিয়েই সে ক্ষান্ত হয় না। রাতে খেয়েই যাঁদের ঘুমানোর বদভ্যাস রয়েছে, তাঁদের মহৌষধ লোডশেডিং। বিছানায় শোয়ামাত্রই বিদ্যুৎ চলে যায়। বাধ্য হয়ে তাঁরা বিছানা থেকে উঠে হাঁটাহাঁটি করেন। এভাবে জাতীয় সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত হচ্ছে। এ ছাড়া ভ্যাপসা গরমে মধ্যরাতে বীরদর্পে ঘরে ঢুকে পরের দিনের কাজের জন্য লোডশেডিং আমাদের ‘ওয়ার্ম আপ’ করে!
দেশে চলছে হিন্দি সিরিয়ালের আগ্রাসন। তাই দরকার আমাদের সংস্কৃতির পুনর্বাসন। লোডশেডিংয়ের ঝাকানাকা অবদানে আমরা শিগগিরই ফিরে পাব হারানো সিংহাসন! কারণ বিদ্যুতের অভাবে হিন্দি চ্যানেল দেখা যায় না, যদিও অন্যান্য চ্যানেলও পটল তোলে। অন্যদিকে লোডশেডিংয়ের ফলে আমাদের অজুহাত দেওয়াও অনেক সহজ হয়েছে! অন্ধকারে ঠিকমতো রান্না করা যায় না—এই অজুহাতে গিন্নিরা রান্না থেকে পরিত্রাণ পেতে পারেন। একই অছিলায় হোমওয়ার্ক না করেও পার পেতে পারে ছাত্রছাত্রীরা। কয়েকটি সিম দিয়ে যারা একাধিক প্রেম করে, তারা মোবাইল বন্ধের জন্য প্রেমিকাদের কাছে সহজেই কৈফিয়ত দিতে পারে, ‘লোডশেডিংয়ের কারণে মোবাইলে চার্জ ছিল না।’ লোডশেডিং আমাদের ধৈর্য বাড়াতেও অবদান রাখছে। এত লোডশেডিংয়ের মধ্যেও আমরা যে হাসিমুখে সময় কাটাচ্ছি, এটা পৃথিবীর অষ্টম আশ্চর্য! বিদ্যুৎ-ব্যবস্থা, দ্রব্যমূল্য, যান চলাচল ইত্যাদিতে চরম অনিয়ম সত্ত্বেও আমরা হেসেখেলে জীবন পার করছি। এ জন্য আমাদের প্রত্যেকের নাম ‘রিপ্লিজ বিলিভ ইট অর নট’-এ অন্তর্ভুক্ত হওয়া উচিত।
পৃথিবীতে শক্তির অপচয় রোধে কত কিছুই না করা হচ্ছে! শক্তির এই অপচয় রোধে আমরা প্রতিনিয়ত দৃষ্টান্ত তৈরি করে চলেছি। এটা সম্ভব হচ্ছে লোডশেডিংয়ের ফলেই। আরেকটু চেষ্টা করলেই আমরা লোডশেডিংয়ে স্বয়ংসম্পূর্ণ হতে পারি। তখন বিদ্যুতের মূল্যবৃদ্ধিতে আমাদের কিছুই যাবে-আসবে না! তদুপরি, লোডশেডিংয়ের বাম্পার ফলন নিশ্চিত করতে পারলে অতিরিক্ত লোডশেডিং বিদেশে রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রাও অর্জন করা যেতে পারে! যুগে যুগে বিদ্যুৎ ব্যবহার করে কত কিছু আবিষ্কার করা হয়েছে। তেমনি একটু খাটুনি খাটলেই লোডশেডিং ব্যবহার করেও হয়তো নতুন কিছু আবিষ্কার করা সম্ভব হবে!
অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ কিছু কাজের জন্য অল্প হলেও বিদ্যুতের প্রয়োজন। যেমন, ফেসবুকে স্ট্যাটাস আপডেটিং। অভিমানের সুরে নয়, অভিযোগের তালে বলছি, দূর-দূরান্ত থেকে আসা ‘অতিথি বিদ্যুৎ’ আমাদের দরকার নেই। বায়োগ্যাস বা সোলার প্যানেলের সাহায্যে আমরা ল্যাপটপে চার্জ দিতে পারি। বিদ্যুৎহীনতায় যাঁদের ব্যবসায় লালবাতি জ্বলেছে, তাঁরা কাছা মেরে আইপিএসের ব্যবসায় নেমে পড়ুন। দরকার হলে আইপিএস ব্যবহার করব; তবুও মিথ্যা প্রতিশ্রুতি দেওয়া বিদ্যুৎকে আমরা ঘরে ঢুকতে দেব না। আসুন, আমরা স্বাগত জানাই লোডশেডিংকে। বৈশাখ আসার আগেই গেয়ে উঠি, ‘এসো হে লোডশেডিং, এসো এসো!’

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-04-09/news/238964

শুক্রবার, ২৪ আগস্ট, ২০১২

বাড়ি আমার, আমি বাড়িতে থাকি, কিন্তু বাড়ির কাজকর্মে আমার কথা চলে না।...

জাতির জীবনে এটা একটা কালো দিন হিসেবে চিহ্নিত হয়ে থাকবে। আমাদের সরকার গরিব মহিলাদের মালিকানায় এবং তাদেরই তত্ত্বাবধানে সুপরিচালিত বিশ্বময় সুপরিচিত নোবেল পুরস্কার বিজয়ী একটি প্রতিষ্ঠান থেকে তার মৌলিকত্ব কেড়ে নিয়ে তাকে অন্য রকম প্রতিষ্ঠানে পরিণত করল। এ দুঃখ ধারণ করার ক্ষমতা আমার নেই।
কী করেছিল গ্রামীণ ব্যাংক, যার জন্য তাকে তার মৌলিকত্ব হারাতে হলো?
৮০ লাখ গরিব মহিলা নিজেদের অর্থে শেয়ার কিনে এটার মালিকানায় অধিষ্ঠিত হয়েছে। ৯৭ শতাংশ মালিকানা তাদের। সরকারের মালিকানা ৩ শতাংশ। নিজেদের পয়সায় পরিচালিত এই ব্যাংক একটা বৃহৎ সমবায়ের মতো। এটা নিজের অর্থে চলে। সরকার বা বিদেশ থেকে বা অন্য কোনো প্রতিষ্ঠান থেকে এটা কোনো ঋণ নেয় না, অনুদান নেয় না। তবু কেন বিশ্বব্যাপী বহুলভাবে অনুকরণকৃত এবং অত্যন্ত শ্রদ্ধেয় এই প্রতিষ্ঠানকে সরকারের অন্য দশটি প্রতিষ্ঠানে পরিণত করতে হলো?
সরকার বলছেন যে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগে অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল। এই অচলাবস্থা কে সৃষ্টি করেছিল? ব্যাংকের মালিকেরা আইনগত প্রক্রিয়ায় একজন ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য সিলেকশন কমিটি গঠন করেছিলেন। যেহেতু এই সিলেকশন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে তাঁরা আমার নাম এবং অন্যান্য সদস্য হিসেবে ড. আকবর আলি খান এবং জনাব খালেদ শামসের নাম প্রস্তাব করেছিলেন, সরকারের প্রতিনিধি, বোর্ডের চেয়ারম্যান এই প্রস্তাব বোর্ডের সিদ্ধান্ত হিসেবে গ্রহণ করতে নারাজ থাকেন। অদ্ভুত পরিস্থিতি। গ্রামীণ ব্যাংকের বোর্ডে ‘ভেটো’ দেওয়ার ক্ষমতা আইন কাউকে দেয় নাই। চেয়ারম্যান সাহেব গায়ের জোরে ভেটো দিয়ে যেতে থাকলেন পর পর তিনটি বোর্ড মিটিংয়ে। একেই বলা হচ্ছে অচলাবস্থা। তার জন্য এখন আইন সংশোধন করে পুরো ব্যাংকের ভবিষ্যৎটাই মূলত চেয়ারম্যান সাহেবের হাতে তুলে দেওয়া হলো।
সরকার থেকে বারবার বলা হচ্ছে, ‘আমরা গ্রামীণ ব্যাংক দখল করিও নাই, করতে যাচ্ছিও না। ইউনূস সাহেব মিথ্যাচার করছেন। গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদের কর্তৃত্ব আগের মতোই আছে। তাদের সঙ্গে পরামর্শ করেই চেয়ারম্যান সিলেকশন কমিটি গঠন করবেন।’ পরামর্শ কখন করে, আর ভোট কখন নেয়? যখন ক্ষমতা একজনের হাতে থাকে তখন পরামর্শ করে। ভোট নেয় যখন ক্ষমতা ভোটদাতাদের কাছে থাকে। গ্রামীণ ব্যাংকের অধ্যাদেশ সংশোধন করে এখন মালিকদের ভোটদানের ক্ষমতা রহিত করে তাদেরকে ‘পরামর্শ’ দেওয়ার ভূমিকায় রাখা হলো। তারপর একক চেয়ারম্যান কর্তৃক তৈরি সিলেকশন কমিটি তিনটি নাম বোর্ডের কাছে দেবে। বোর্ডের সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ থাকবে যে এই প্রার্থীরা চেয়ারম্যানের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন। মালিকদের চোখের দিকে তাকিয়ে কাজ করবেন না। যাঁকেই তাঁরা নিয়োগ দিন না কেন, এই পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না।
যে বোর্ডের কাছে সমস্ত ক্ষমতা আগের মতোই রয়ে গেছে বলা হচ্ছে, সে বোর্ড কিছু জানার আগেই সরকার থেকে সাফ জানিয়ে দেওয়া হচ্ছে যে বোর্ড সদস্যরা যা চাচ্ছেন তা হতে দেওয়া হবে না। কেন হতে দেওয়া হবে না? কারণ ক্ষমতা সরকারের হাতে। সরকার বলছে ‘সিলেকশন কমিটি’ এক সপ্তাহের মধ্যে হয়ে যাবে। এটা কি বোর্ডের কথা, নাকি সরকারের কথা? এবং তাতে ইউনূস থাকবে না। কারণ কী? কারণ সরকার এটা সিদ্ধান্ত নিয়ে নিয়েছে। ব্যবস্থাপনা পরিচালক নিয়োগের জন্য আন্তর্জাতিক বিজ্ঞাপন দেওয়া হবে। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত? ব্যবস্থাপনা পরিচালকের বেতন আকর্ষণীয় অঙ্কের হবে, তা না হলে আন্তর্জাতিক মানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক পাওয়া যাবে না। এটা কি বোর্ডের সিদ্ধান্ত?
অথচ সরকার বলেই যাচ্ছে গ্রামীণ ব্যাংকের ব্যাপারে সরকার কোনো হস্তক্ষেপ করবে না। সরকার আইন সংশোধনের আগেই এত কিছু সিদ্ধান্ত নিয়ে নিল, আইন সংশোধনের পরে কী হয়, এবার আমাদের দেখার পালা।
আইনে সংশোধনী এনে সরকার প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগে ভূমিকা রেখে প্রকারান্তরে গ্রামীণ ব্যাংক পরিচালনার দায়দায়িত্ব নিজের হাতে তুলে নিল। দুনিয়ার কোথাও নজির নাই যে বহুজনের ব্যক্তিমালিকানায় পরিচালিত একটি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী নিয়োগের ক্ষমতা ৩ শতাংশ মালিকানার অংশীদারের হাতে তুলে দেওয়া হয়েছে।
অধ্যাদেশ সংশোধনের ব্যাপারে মন্ত্রিসভার সিদ্ধান্তের পর আমি দেশের মানুষের প্রতি আবেদন জানিয়েছিলাম সরকারকে বোঝানোর জন্য, যাতে সরকার এই সংশোধনের পথে অগ্রসর না হয়। দেশের বহু মানুষ বিবৃতির মাধ্যমে, সভা ও মানববন্ধনের মাধ্যমে, গণমাধ্যমে আলোচনা ও লেখালেখির মাধ্যমে প্রতিবাদ জানিয়েছেন। বিশেষ করে, দলমত-নির্বিশেষে দেশের বহু সম্মানিত মহিলা নেত্রী এ ব্যাপারে সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। গরিব মহিলাদের পাশে দাঁড়ানোর জন্য আমি তাঁদের সকলকে অশেষ ধন্যবাদ জানাচ্ছি। শুধু দুঃখ রইল যে সরকার আমাদের কারও কথা শুনল না।
এই সংশোধনীর ফলে গ্রামীণ ব্যাংকের গৌরবময় ইতিহাসের সমাপ্তি পর্বের সূচনা হলো। এখন থেকে গরিব মহিলাদের মালিকানার ব্যাংকটি সরকারের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে পরিচালিত হবে। ইতিহাসে নজির খুঁজে পাওয়া যাবে না যে এ রকম পদক্ষেপের ফলে প্রতিষ্ঠানের মঙ্গল হয়েছে।
আমি আমার দুঃখ প্রকাশের ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না। গ্রামীণ ব্যাংকের অসংখ্য কর্মী সারা জীবন পরিশ্রম করে একটি স্বপ্নকে বাস্তবায়ন করার জন্য এই ব্যাংকটিকে দুনিয়ার একটা অনন্য প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তুলেছিল। আজ এর সমাপ্তি হতে দেখে তারাও তাদের দুঃখ রাখার জায়গা পাচ্ছে না।
যে গরিব মালিকেরা তাদের নগদ পয়সা দিয়ে এটার শেয়ার কিনে এটাকে ‘আমাদের ব্যাংক’ হিসেবে জানতে শিখেছিল, গৌরব করতে শিখেছিল, তারা এখন জানবে যে এটা এখনো তাদের ব্যাংক বটে তবে এর ব্যাপারে মৌলিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা এখন
তাদের হাতে নেই। বাড়ি আমার, আমি বাড়িতে থাকি, কিন্তু বাড়ির কাজকর্মে আমার কথা চলে না।
আমি আশাবাদী মানুষ। আমি হতাশ হতে চাই না। নিজের মনে আশার ক্ষীণ আলো জাগিয়ে রাখতে চাই। আমি আগের মতো আবারও দেশবাসীর কাছে আহ্বান জানাচ্ছি যে, তাঁরা যেন এর প্রতিকারের ব্যবস্থা করেন। আমি দেশের তরুণদের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি, তারা যেন একদিন গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকদেরকে এই দুঃস্বপ্ন থেকে মুক্ত করে নিয়ে আসে এবং গ্রামীণ ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণ তাদেরকে ফিরিয়ে দিতে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ থাকে। গরিব মালিকদের পরিবারের তরুণেরাও যেন এই প্রতিজ্ঞা করে যে, তাদের মায়েদের সম্পদ তারা তাদের মায়েদেরকে ফেরত এনে দেবে। তাদের ব্যাংক তাদের কাছে যেন আবার পূর্ণ ক্ষমতায় ফিরে আসে। আশা করি ভবিষ্যতে একদিন আমাদের দেশে এমন সরকার আসবে, যাদের প্রথম কাজ হবে, একটি জাতীয় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে গরিব মহিলাদের এই ব্যাংকটিকে গরিব মহিলাদের হাতে তুলে দিয়ে এই ব্যাংকের গৌরবময় অগ্রযাত্রাকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা। সেদিন দেশের সকল মানুষ স্বস্তি পাবে, গরিব মহিলাদের মঙ্গলকামী পৃথিবীর সকল মানুষ স্বস্তি পাবে।
আজ দুঃখের দিনে সে রকম একটি সুখের দিনের কথা চিন্তা করা ছাড়া মনকে সান্ত্বনা দেবার আর কিছু খুঁজে পাচ্ছি না।
 ড. মুহাম্মদ ইউনূস: গ্রামীণ ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা ও নোবেল শান্তি পুরস্কার বিজয়ী।
 
http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-08-24/news/283340

শুক্রবার, ৬ জুলাই, ২০১২

আওয়ামী লীগের পৃথিবী ছোট হয়ে আসছে?

পদ্মা সেতু প্রকল্পে বিশ্বব্যাংকের ঋণচুক্তি বাতিল নিয়ে দেশব্যাপী তোলপাড় হচ্ছে। ঋণচুক্তি বাতিল হওয়ার পর জনদরদি মহাজোট সরকার বিশ্বব্যাংক যে কত বড় দুর্নীতিবাজ, তা প্রমাণ করতে উঠেপড়ে লেগেছে। পৃথিবীর কোন দেশের নামকরা অর্থনীতিবিদ বিশ্বব্যাংকের দুর্নীতি সম্পর্কে কী মন্তব্য করেছেন, কোন পত্রিকা কী প্রতিবেদন করেছে, তার ফিরিস্তি দিচ্ছেন মন্ত্রীরা। বিশ্বব্যাংক যদি এত খারাপ প্রতিষ্ঠানই হয়ে থাকে, তাহলে ঋণচুক্তি করার আগে কেন দেশবাসীকে সে সম্পর্কে কিছু জানানো হলো না? কেন জনগণকে জিজ্ঞাসা করা হলো না, এই বদনামি প্রতিষ্ঠানটির সঙ্গে আমাদের চুক্তি করা ঠিক হবে কি না? ঋণচুক্তি বাতিলের পর জাতীয় সংসদের উপনেতা সাজেদা চৌধুরী তো বলেই ফেলেছেন, ‘এক বেলা বাজার না করে সেই পয়সা দিয়ে পদ্মা সেতু করবেন।’ কিন্তু বিশ্বব্যাংক দুর্নীতির অভিযোগ উত্থাপনের আগে কেন এ আহ্বান জানালেন না তিনি? তখন যদি এক বেলা বাজার না করে (মাননীয়ার কাছে জানতে চাই, বাংলাদেশের কতজন মানুষ দিনে দুই বেলা বাজার করে?) নিজেদের অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলতেন, মানুষ বিশ্বাস করত। এখন বিশ্বব্যাংকের কাছ থেকে প্রত্যাখ্যাত হয়ে স্বদেশপ্রেমের মশাল জ্বালালে তাতে ঘর আলোকিত হওয়ার চেয়ে পুড়ে যাওয়ার আশঙ্কাই বেশি।
এ গেল মুদ্রার এক পিঠ। অপর পিঠে যাঁরা আছেন, তাঁদের ধারণা, পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংকের ঋণ বাতিল হওয়ায় দেশের মহাসর্বনাশ হয়ে গেছে। দেশের ভাবমূর্তি একেবারে তলানিতে এসে ঠেকেছে। কথাটি ঠিক নয়। আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বিশ্বব্যাংককে মানুষ একটি বেনিয়া প্রতিষ্ঠানের বাইরে কিছু দেখে না। অর্থমন্ত্রী বলেছেন, বিশ্বব্যাংকের চিঠি গোটা দেশের জন্য অপমানকর। বিশ্বব্যাংকের চিঠি যদি অপমানকর হয়ে থাকে, চুক্তি সই করেও যাঁরা টাকা আনতে পারেননি, তাঁদের জন্য অপমানকর। সারা দেশের মানুষের জন্য নয়। এ অপমান তাঁদেরই প্রাপ্য, যাঁরা দুষ্কর্ম করেছেন বা করতে চেয়েছিলেন এবং যাঁরা তাঁদের রক্ষা করতে চাইছেন।
প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেত্রী জাতীয় সংসদে আত্মপক্ষ সমর্থন করতে গিয়ে যা বলেছেন, তা স্ববিরোধিতাপূর্ণ। একদিকে তিনি বলেছেন, বিশ্বব্যাংক যেহেতু এক পয়সাও দেয়নি, সেহেতু দুর্নীতির প্রশ্নই আসে না। বিশ্বব্যাংক কখনোই বলেনি যে ঘুষের লেনদেন হয়েছে। তারা বলেছে, কানাডীয় পরামর্শক প্রতিষ্ঠানটির কাছে ঘুষ চাওয়া হয়েছে। আর ঘুষ যদি না-ই চাওয়া হবে, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী ও সচিবকে কেন সরালেন? প্রকল্প পরিচালককে কেন সরালেন? প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, যদি প্রমাণিত হয় মন্ত্রী দায়ী, তাঁকে অপসারণ করা হবে। তদন্তের পরই প্রমাণ পাওয়া যাবে মন্ত্রী দুর্নীতি করেছেন বা করার চেষ্টা করেছেন কি না। আমরা প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্যকে সমর্থন করি। এখনো বিষয়টি তদন্তাধীন। অতএব, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত সেই অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রিসভার বাইরে রাখুন। যদি তিনি নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে পারেন, তাহলে আবার পুনর্বহাল হবেন। অভিযুক্ত ব্যক্তিকে মন্ত্রীর পদে রেখে (তা যে মন্ত্রণালয়েই হোক না কেন) সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ তদন্ত হতে পারে না। এ কথাটি কেবল বিশ্বব্যাংকের নয়, বাংলাদেশের মানুষেরও। রেলওয়ের অর্থ কেলেঙ্কারির জন্য যদি রেলমন্ত্রী সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত পদত্যাগ করতে পারেন, সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী পারবেন না কেন? মহাজোটের শরিক হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ এবং আওয়ামী লীগের নেতা মোহাম্মদ নাসিমও বলেছেন, সৈয়দ আবুল হোসেনের সরে দাঁড়ানো উচিত। তাঁরাও কি বিশ্বব্যাংকের দালাল?
তবে এখানে একটি কথা বলা প্রয়োজন, বিশ্বব্যাংকের ঋণ না পেলেও আমাদের উদ্বিগ্ন হওয়ার কিছু নেই। যেসব দেশে বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, সেসব দেশ ধ্বংস হয়ে যায়নি; বরং বিশ্বব্যাংকের ঋণ নিয়ে স্বনির্ভর হয়েছে, এ রকম উদাহরণই কম। তারা অনেক সময় এমন সব প্রকল্প চাপিয়ে দেয়, যা মানুষের উপকারের চেয়ে অপকারই বেশি করে। তাই বিশ্বব্যাংকের ১২০ কোটি ডলারের ঋণচুক্তি বাতিল করা নিয়ে বিরোধী দলের শোরগোল তোলার যুক্তি আছে বলে মনে করি না। কিন্তু সেই ‘বিতর্কিত’ প্রতিষ্ঠানটি যখন আমাদের সরকারের সততা নিয়ে প্রশ্ন তোলে কিংবা মন্ত্রীর বিরুদ্ধে দুর্নীতির অভিযোগ আনে, তখন লজ্জায় মাথা কাটা যায়।
পদ্মা সেতুতে বিশ্বব্যাংক অর্থায়ন না করলেও সেতু নির্মাণের কাজ ঠেকে থাকবে না। বাংলাদেশের মানুষের জন্য দরদ উথলে ওঠার জন্য বিশ্বব্যাংক ঋণ দেয় না, তারা ঋণ দেয় ব্যবসা বাড়ানোর জন্য। বিশ্বব্যাংকের ঋণের পেছনে যে বড় রাজনীতি আছে, তাও ভুলে গেলে চলবে না। আমাদের সরকারগুলো কখনোই মেরুদণ্ড খাড়া করে দাঁড়াতে পারে না, তারা নির্দ্বিধায় বিশ্বব্যাংক ও আইএমএফের ন্যায্য-অন্যায্য সব শর্তই মেনে নেয়।
সরকারের মন্ত্রীরা নিজস্ব অর্থায়নে পদ্মা সেতু করার কথা বলছেন। আমরা এ-ও জানি, এই সরকারের অনেক মন্ত্রী-এমপি নিজস্ব অর্থায়নেও এ রকম একাধিক পদ্মা সেতু করতে পারেন। দেশি-বিদেশি ব্যাংকে সেই পরিমাণ অর্থ তাঁদের জমা আছে। কিন্তু তাতে বিশ্বব্যাংক সরকারের গায়ে যে কালিমা লেপন করল, তা মুছে যাবে না। অতএব, বিশ্বব্যাংক নয়, সরকার ও জনগণের স্বার্থেই দোষীদের শাস্তি দিতে হবে।
২০০৮ সালে বাংলাদেশের মানুষ যে দলটিকে সন্ত্রাস ও দুর্নীতির কারণে প্রত্যাখ্যান করেছিল, সেই দলটিই এখন মহাজোট সরকারকে মহাদুর্নীতিবাজ আখ্যায়িত করছে। সরকারের পদত্যাগ চাইছে। এটি বাংলাদেশের রাজনীতির মস্ত বড় ট্র্যাজিডিও বটে।
প্রধানমন্ত্রী পদ্মা সেতুতে দুর্নীতি প্রমাণিত হয়নি বলে দাবি করেছেন। দুর্নীতি বলতে তিনি কি ঘুষের টাকার লেনদেন বোঝাচ্ছেন? বিশ্বব্যাংকও বলেনি যে ঘুষের টাকা লেনদেন হয়েছে। তাদের দাবি, ঘুষ চাওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী যদি মনে করেন বিশ্বব্যাংকের অভিযোগের কোনো ভিত্তিই নেই, তাহলে তিনি সাবেক যোগাযোগমন্ত্রী সৈয়দ আবুল হোসেন, তাঁর সচিব ও প্রকল্প পরিচালককে সরালেন কেন? এর মাধ্যমে নিশ্চয়ই তিনি বিশ্বব্যাংক-উত্থাপিত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত নিশ্চিত করতে চেয়েছেন। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনৈতিক বাস্তবতা হলো, একজন মন্ত্রীকে স্বপদে (যে মন্ত্রণালয়েই তাঁকে বদলি করা হোক না কেন) বহাল রেখে তাঁর বিরুদ্ধে আনীত অভিযোগের বিশ্বাসযোগ্য তদন্ত করা যায় না।
বাংলাদেশে এ পর্যন্ত খুব কম মন্ত্রী-আমলাই দুর্নীতির দায়ে শাস্তি ভোগ করেছেন। তাই বলে তাঁরা সৎ লোক হয়ে যাননি। সবার সততা আদালতেও প্রমাণিত হতে হয় না। বর্তমান সরকারে এমন মন্ত্রীও আছেন, যাঁর সম্পর্কে চরম শত্রুও দুর্নীতির অভিযোগ আনবেন না। আনলেও মানুষ বিশ্বাস করবে না। কিন্তু তাই বলে প্রধানমন্ত্রী হলফ করে বলতে পারেন না তাঁর মন্ত্রিসভার সবাই সাধু।

২.
২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন মহাজোট যখন বিপুল ভোটে জয়ী হলো, তখন আওয়ামী লীগের সমর্থক তো বটেই, আওয়ামী ঘরানার বাইরেরও অনেক লেখক, বুদ্ধিজীবীসহ বিভিন্ন শ্রেণী ও পেশার মানুষ আশান্বিত হয়েছিলেন। তাঁরা ভেবেছিলেন, দেশ এবার জঙ্গিবাদ ও সাম্প্রদায়িকতামুক্ত হবে। দুর্নীতি একেবারে উচ্ছেদ না হলেও সহনীয় পর্যায়ে আসবে। স্বাধীনতার পর যাঁরা কখনোই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেননি, তাঁরাও সে সময় আওয়ামী লীগকে মন্দের ভালো বলে মেনে নিয়েছিলেন। ভেবেছিলেন, মহাজোটে বামপন্থীদের অবস্থান যত দুর্বলই হোক, সরকার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে, দেশটি প্রগতির ধারায়ই চলবে। এরপর শেখ হাসিনা যখন পুরোনোদের বাদ দিয়ে নবীনদের নিয়ে মন্ত্রিসভা গঠন করলেন, তখনো তাঁদের মনে এই বিশ্বাস ছিল যে অভিজ্ঞতায় এঁরা কমতি হলেও সততা ও আন্তরিকতায় উতরে যাবেন। কিন্তু কিছুদিন না যেতেই দেশবাসী হোঁচট খেতে শুরু করে। আওয়ামী লীগ অতি দ্রুত মিত্রদের দূরে ঠেলে দেওয়ার নীতি নেয়। দল ও জোটের মধ্যে যাঁরা এক-আধটু বাম চিন্তা করতেন, তাঁদের নানাভাবে অপদস্থ করতে থাকে। আওয়ামী লীগ-নেতৃত্ব ধরেই নিয়েছেন, যতই গালমন্দ করা হোক না কেন, তাঁদের যাওয়ার জায়গা নেই। কেননা, আওয়ামী লীগের বিকল্প হলো বিএনপি এবং তার ছায়াসঙ্গী জামায়াতে ইসলামী। প্রগতিশীল চিন্তার কোনো মানুষ তাদের সমর্থন করতে পারে না। গত সাড়ে তিন বছরে দলটি মুখে জনকল্যাণ ও প্রগতিশীলতার বুলি আওড়ালেও কাজে তার প্রমাণ দিতে পারেনি। ক্ষমতায় এসে বিএনপির মতো আওয়ামী লীগও অসাধু ব্যবসায়ীদের প্রশ্রয় দিয়েছে। এমনকি দুই দলের মধ্যে চরম বৈরিতা সত্ত্বেও দুই দলের সমর্থক অসাধু ব্যবসায়ীদের মধ্যে গভীর আঁতাত লক্ষ করা গেছে। সর্বশেষ পঞ্চদশ সংশোধনীতে বাহাত্তরের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার নামে তারা এমন এক সোনার পাথরবাটি তৈরি করেছে, যাতে রাষ্ট্রধর্ম ও ধর্মনিরপেক্ষতার সম্মিলন ঘটানো হয়েছে। তাহলে নূর হোসেন-তাজুলদের রক্তদান কি বৃথা গেল!
২০০৯ সালে যখন আওয়ামী লীগ দিনবদলের স্লোগান নিয়ে ক্ষমতায় এল, তখন মানুষ আশা করেছিল, এবার আওয়ামী লীগ কিছুটা হলেও বদলাবে। সেই ধারণার অন্যতম কারণ ছিল, নির্বাচনে বিতর্কিত কোনো নেতাকে মনোনয়ন না দেওয়া, বিশেষ করে ১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে যাঁরা দলের মুখে চুনকালি মেখে দিয়েছিলেন, সেই হামবড়া নেতাদের মনোনয়ন না দিয়ে শেখ হাসিনা দলের বাইরেও প্রশংসিত হয়েছিলেন। এখন আবার তাঁদের কেউ কেউ নাকি দলীয় নেতৃত্বের আশীর্বাদ পেতে শুরু করেছেন।
বিএনপির আমলে জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও দুর্নীতির মহোৎসবের কারণে আওয়ামী ঘরানার বাইরের অনেকেই আওয়ামী লীগকে সমর্থন করেছিলেন এই আশায় যে ধর্মান্ধতা ও প্রতিক্রিয়াশীলতার বৃত্ত থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ সামনে এগিয়ে যাবে। বাংলা ভাই বা শায়খ আবদুর রহমানের দৌরাত্ম্য কমবে, যুদ্ধাপরাধীদের আস্ফাালন দেখতে হবে না।
ক্ষমতায় থাকতে বিএনপির কতিপয় সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দলটিকে প্রায় একঘরে করে তুলেছিল, বিশেষ করে জঙ্গি উত্থানের ব্যাপারে তারা গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তিই দাঁড় করাতে পারেনি। এরই পরিপ্রেক্ষিতে যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ অনেক পশ্চিমা দেশই বিএনপিকে গণতন্ত্রের জন্য ‘বিপজ্জনক’ বলে মনে করত। ‘মধ্য ডান’ বিএনপি থেকে ‘মধ্য বাম’ আওয়ামী লীগই তাদের পছন্দের দল হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগের অতি আস্থাশীল নেতৃত্ব এবং শেখ হাসিনার ‘পরিচ্ছন্ন মন্ত্রিসভা’ উল্টোরথে চলে। দেশের ভেতরে ও বাইরে যারা তাদের বন্ধু-সুহূদ ছিল, তাদের অনেকেই এখন বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। গত সাড়ে তিন বছরে আওয়ামী লীগ একটি কাজই সুচারুভাবে করেছে তা হলো, মিত্র-সমর্থক-শুভানুধ্যায়ীদের খেপিয়ে তোলা এবং বিএনপির ম্রিয়মাণ ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করা। সবকিছু দেখে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগের পৃথিবী ক্রমশ ছোট হয়ে আসছে।
 সোহরাব হাসান: কবি, সাংবাদিক।


http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-07-07/news/271508

সোমবার, ৪ জুন, ২০১২

‘এভারেস্ট জয় কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’—এই মর্মে রুল জারি

সম্প্রতি এভারেস্ট জয় করেছেন বাংলাদেশের দুই নারী। এই দুজনের বদলে যদি বাংলাদেশের প্রধান দুই রাজনৈতিক দলের যেকোনো দুই রাজনীতিবিদ এভারেস্ট জয় করতেন, কী ঘটত তখন? জানাচ্ছেন আলিম আল রাজি

সরকারি দল
এভারেস্ট জয় করায় সারা দেশে আনন্দ মিছিল করত ছাত্রলীগ। পাড়ায় পাড়ায় মিষ্টি বিতরণ করতে দেখা যেত নেতাদের। বিভিন্ন জায়গায় করা হতো সভা-সমাবেশ। সেসব সমাবেশকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের বিভিন্ন গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ হতো। পত্রিকায় খবর আসত—এভারেস্টকে কেন্দ্র করে ছাত্রলীগের দুই গ্রুপের মধ্যে সংঘর্ষ। নিহত ৫, আহত ৫০।
এভারেস্টজয়ীকে শুভেচ্ছা ও ধন্যবাদ জানাতেন বিরোধীদলীয় মহাসচিব। তিনি বলতেন, ‘আসলে সরকারি দল এভারেস্ট জয় করতে পেরেছে তার মূল কারণ হলো আমরা যখন ক্ষমতায় ছিলাম তখন এভারেস্টে ওঠার রাস্তাটি পাকা করে দিয়েছিলাম।’
ঠিক পরের দিন সংবাদ সম্মেলন করে আগে দেওয়া ধন্যবাদ ফিরিয়ে নিতেন বিরোধীদলীয় মহাসচিব। ‘আসলে প্রথম দিন বুঝিনি মূল ব্যাপারটা। আমি আরও ভেবেছিলাম বাসার ছাদকে এভারেস্ট বলা হয়। আজ আমার বুদ্ধি বেড়েছে। বুদ্ধি বাড়ার পর এখন দেখি ঘটনা অন্য রকম। এভারেস্ট উঁচু একটা জিনিস। এটার ওপরে তিনি উঠবেন কীভাবে? এত বড় মই তিনি পেলেন কোথায়? যে দেশে কোনো উন্নয়নই নেই, সে দেশে এত বড় মই তৈরি হতে পারে না। তাই এভারেস্ট জয় পুরো ফাউল একটা ব্যাপার!’ এই মর্মে বিবৃতি দিতেন তিনি।
এদিকে এভারেস্টজয়ীকে অভিনন্দন জানিয়ে বিশাল সমাবেশ করত ছাত্রলীগ। সেখানে জয়ীকে ‘এভারেস্ট মানব, এভারেস্ট মানবী’ ইত্যাদি উপাধিতে ভূষিত করা হতো।
সঙ্গে সরকারের তরফ থেকে জানানো হতো, এই সরকারই আসলে এভারেস্টের মূল প্রতিষ্ঠাতা। এর আগে এভারেস্ট নামক কোনো কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। এই সরকার এসে এভারেস্ট তৈরি করেছে এবং জয় করেছে। এখন বিরোধী দল ষড়যন্ত্র করে এভারেস্ট ধ্বংস করতে চায়। তাদের ষড়যন্ত্র সফল হবে না।
চলমান এভারেস্ট জটিলতা নিরসনে দুই নেত্রীকে সংলাপে বসার আহ্বান জানাতেন জ্ঞানী লোকজন। ‘উক্ত সংলাপে’ মার্কিন রাষ্ট্রদূতের হস্তক্ষেপও কামনা করতেন অনেকে। সংলাপে বসার ব্যাপারে শত শত শর্ত জুড়ে দিত দুই দলই।
দেশে এত পাহাড় থাকতে সরকারি দল কেন বিদেশের এভারেস্টে উঠতে গেল। এর প্রতিবাদে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল ডাকত বিরোধী দল। সরকারকে বিদেশিদের দালাল বলে আখ্যা দিত তারা। তথাকথিত এভারেস্ট জয়ের অপরাধে এই তাঁবেদার সরকারের এখনই পদত্যাগ করা উচিত বলে মন্তব্য করতেন বিরোধী দলের নেতারা।
এভারেস্ট জয়ের প্রতিবাদে সারা দেশে সকাল-সন্ধ্যা হরতাল চলত। গাড়ি পুড়িয়ে মানুষ মারত বিরোধী দল। অন্যদিকে পুলিশ ভাইয়েরা বিরোধীদলীয় নেতাদের মেরে তাদের হাড্ডিগুড্ডি ভেঙে দিত।
পরিশেষে সন্ধ্যাবেলা হরতাল সফল হয়েছে এবং সরকারের এভারেস্ট জয় জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে—এই মর্মে বিবৃতি দিত বিরোধী দল। জবাবে বিরোধী দলের হরতাল জনগণ প্রত্যাখ্যান করেছে, এটা জানাত সরকারি দল।

বিরোধী দল
তাৎক্ষণিক সংবাদ সম্মেলন করে দেশবাসীকে অভিনন্দন জানাতেন বিরোধীদলীয় নেত্রী। তাঁর আশপাশে বসা থাকতেন ১৮ দলের নেতারা। ‘আমাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছিল সরকার। তাতে কী হয়েছে? আমার দল বাড়ি থেকে বেরিয়ে সোজা এভারেস্টের চূড়ায় উঠে গিয়েছে। তাই আমাদের দমিয়ে রাখা যাবে না। জনগণ আমাদের সাথে আছে।’ এই মর্মে বিবৃতি দিতেন তিনি।
বিরোধী দলের অন্য নেতারা জানাতেন, তাঁদের দল ক্ষমতায় এলে ঘরে ঘরে এভারেস্ট গড়ে তোলা হবে। ‘একটি বাড়ি একটি এভারেস্ট’ প্রকল্প চালু করা হবে। তখন আর কেউ একা এভারেস্টে উঠবে না। দেশের ১৫ কোটি মানুষকে নিয়ে তাঁদের সরকার এভারেস্ট জয় করবে।
আস্তে আস্তে মুখ খুলতে শুরু করত সরকারি দল। মন্ত্রীরা বলতেন, এভারেস্ট জয় এমন কোনো জরুরি ঘটনা নয়। স্থানীয় সরকারমন্ত্রী এক সভায় জানাতেন, তিনি তিন বেলা খাওয়ার আগে ও পরে এভারেস্ট জয় করেন। তা ছাড়া বিদেশিদের ‘শক্ত তরল’ খাইয়ে, ফোন করে এভারেস্ট জয় করার মূল্য নেই।

আরেক কাঠি বাড়িয়ে পরের দিন বক্তৃতা দিতেন আইনমন্ত্রী। তিনি বলতেন, ‘এভারেস্ট বলে কিছু নেই। এভারেস্ট বিরোধী দলের কল্পনা মাত্র। যে জিনিসের অস্তিত্বই নেই, সেই জিনিস কীভাবে জয় করা যায়? তাই বিরোধী দলের এই দাবি অত্যন্ত ফালতু।’
‘এভারেস্ট জয় কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না’—এই মর্মে রুল জারি করা হতো। তিন দিনের ভেতরে সেই রুলের জবাব দিতে বলা হতো।
সরকারের এসব কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে ফুঁসে উঠত বিরোধী দল। সরকারের ফ্যাসিবাদী আচরণের প্রতিবাদে এভারেস্ট অভিমুখে লংমার্চ ডাকত তারা। লংমার্চে হানা দিত পুলিশ ও ছাত্রলীগ। পিটিয়ে পিঠের ছাল তুলে ফেলা হতো বিরোধী দলের নেতাদের। লংমার্চ থেকে গ্রেপ্তার করে নেওয়া হতো ৩৩ জন নেতা-কর্মীকে।
বাতিল করে দেওয়া হতো এভারেস্ট জয়। গ্রেপ্তার করা হতো এভারেস্টজয়ীকে। তিন দিনের রিমান্ডে নেওয়া হতো তাকে। পত্রিকায় খবর আসত, ‘এভারেস্ট নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য দিয়েছেন সেই এভারেস্টজয়ী।’ কী সেই চাঞ্চল্যকর তথ্য তা আর জানার সুযোগ হতো না কারও।

হীরক রাজার দেশে পুলিশের বেশে!!!

গবেষক: রাজামশায়, রাজ্যে এমন কী ঘটেছে, আসতে হলো আবার
গত সপ্তায় না এলাম, এর ভেতরেই নতুন কাভার?
নিশ্চয় ঘটেছে ভয়ানক কিছু, তা না হলে রাজা কেন চুপ
কী এমন ঘটেছে রাজ্যে, কেন এমন তাহার রূপ?
রাজা: চুপ করো গবেষক, সাধে কী আর ডেকেছি,
রাজ্যে এসব হচ্ছেটা কী, এই জন্য কি তোমাদের রেখেছি?
গবেষক: রাজামশায়, কী হয়েছে সবকিছু বলুন খুলে
বেশিক্ষণ ধরে রাখলে শেষে না আবার পেটটা যায় ফুলে!
রাজা: রাজ্যে এসব হচ্ছেটা কী, প্রকাশ্যে পুলিশের হাতে প্রহার
গবেষক: ওদের খাদ্যাভ্যাসে চেঞ্জ এসেছে, এখন এসবই তো আহার!
রাজা: রাজ্যের পুলিশ কী শুরু করছে এই সব
দুই দিন পর পর অভিযোগ,
আজ একে মারে তো কাল ওর গায়ে তোলে হাত
কে দিল তাদের এ সুযোগ?
গবেষক: রাজামশায়, হাসালেন, এটা কোনো ঘটনা!
এই রকম কত কিছুই তো রটে, নাকি রটে না?
পুলিশের কাজ পুলিশ করেছে হাত তুলেছে গায়,
এ নিয়ে টেনশন করা কি রাজার শোভা পায়?
রাজা: ছিঃ ছিঃ! আমার রাজ্যের পুলিশ এতই বোকা!
সামান্য কটা ঘটনা দিতে পারে না ধামাচাপা
এত এত ঘটনা চোখের সামনে তুলে রেখে
শেষে কিনা পচা শামুকে কাটলি দু-পা!
গবেষক: এই নিয়ে আপনি মোটেও নেবেন না পেইন,
হীরক রাজ্যে নতুন মন্ত্র—নো পেইন, অনলি গেইন!
রাজা: তা না হয় মানলাম কিন্তু এত কিছু কেন শুনি
রাজ্যে কেন চলছে এই সব নিয়ে কানাকানি!
জলদি করে বলে দাও, স্বয়ং রাজা চায় এর বিচার
আপাতত কাজ চালাতে এক-এ এক-এ মিলিয়ে দাও চার!
গবেষক: পুলিশের বিচার করবে পুলিশ!
পুলিশে পুলিশে জ্ঞাতি ভাই,
কাকের মাংস কাকে খায় না
ইহার উপর সত্য নাই!
রাজা: সত্য-মিথ্যা জানি না, একটা কিছু করো,
ভালো-খারাপ বুঝি না, আপাতত কজন ধরো!
গবেষক: পুলিশ এখন চলে যাচ্ছে ধরাছোঁয়ার বাইরে,
রাজা: পুলিশকে কন্ট্রোল করার হিম্মত কি কারও নাই রে!
গবেষক: পুলিশ থেকে নিরাপদ দূরে থাকতে
পরামর্শ দিয়েছেন প্রতিমন্ত্রী,
রাজা: পুলিশ কি আর মানুষ নেই!
যন্ত্র-মানব নাকি ষড়যন্ত্রী?
গবেষক: রাজামশায়, রাজ্যের যত বড় বড় পুলিশ
শুনেছি সবার নাকি রাজার এলাকায় বাড়ি,
এটা কি রাজার নতুন কোনো শখ
নাকি অন্য এলাকার পুলিশগুলো আনাড়ি!
রাজা: কে বলে এসব কথা, কোত্থেকে বয় এই বাতাস?
ভেবেছ কী, ভাত না খেয়ে হীরকের রাজা খায় শুধু ঘাস?
গবেষক: রাজামশায়, মাফ করবেন, এতটা লাগবে বুঝিনি,
আপনার সাথে থাকি তো, টক-ঝাল বুঝি না, বুঝি শুধু চিনি!
রাজা: হীরকের দেশে পুলিশের বেশে কে হাসে ওই ভয়ানক হাসি?
গবেষক: আর কে মশায়, জামাটা খুললেই তো সেই পুরোনো-বাসি!
আচ্ছা, রাজামশায় কি পড়েছেন বইটা, ফ্রাংকেনস্টাইন নাম তার
রাজা: কী আছে ওতে, হঠাৎ এ বইয়ের কেন অবতার?
গবেষক: সেখানে ছিল এক পাগলা ডাক্তার,
মানুষ মেরে বেশ নামডাক তার।
রাজা: দেখেছ, মানুষ মারলেও নাম-ডাক হয়!
গবেষক: কিন্তু সেই নাম আর কয়দিনই বা রয়!
মৃত জোড়া দিয়ে সে বানিয়েছিল এক প্রকাণ্ড দানব
ভেবেছিল ওটা কথা শুনবে, হায়রে বোকা মানব!
রাজা: কী? কথা শোনেনি, এত বড় স্পর্ধা ওই সামান্য দানবের!
গবেষক: জি, নিজের তৈরি দানবই জান নিয়েছিল মনিবের!
রাজা: এতক্ষণে বুঝলাম, কিছু একটার ইঙ্গিত আছে তোমার কথায়,
ঝটপট বলে ফেলো, দেখি লুকিয়ে রেখেছ কোথায়?
গবেষক: রাজা দেখি আজকাল ইঙ্গিতও বোঝেন
আর কদিন পর তো হয়ে উঠবেন আইনস্টাইন,
শুধু এটা বোঝেন না, এই পোষা পুলিশগুলো
একদিন হয়ে উঠতে পারে ফ্রাংকেনস্টাইন!
রাজা: হীরকের রাজ্যে দানব আসবে?
রাজার চেয়ে বড় দানব আছে নাকি তল্লাটে!
কি, ঠিক কি না?
গবেষক: ঠিক ঠিক
এলে আসুক, আমরাও গুনে দেখব
কত বড় মাইক আছে কার কল্লাতে!
রাজা: শাট আপ, চুপ করো, ব্যাটা গবেষক
ভয় করছে, দরজায় কে যেন করল নক!
গবেষক: ছিঃ ছিঃ! রাজামশায়, ভয় পেলে কি চলবে?
হীরকের রাজা ভয় পেলে লোকে কী বলবে!
রাজা: লোকের কথার খেতা পুড়ি, আছে তো বেশ সুখে
জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভেঙে পুরব সবাই মুখে!
গবেষক: রাজা কিন্তু ভুল করছেন, জনগণের কথা ভাবুন
পুলিশের হাতে তুলে দেবেন না সব ক্ষমতা
যার যা প্রাপ্য ততটুকুই দিন তাকে
একবার স্বাদ পেলে কেউ ছাড়তে পারে না এর মমতা!
রাজা: বাদ দাও ওসব ফোরকাস্টিং শক
আমি আজ যাই গবেষক, মাথাটা করছে ঝিমঝিম!
গবেষক: আপনি রেস্ট নেন, পুলিশের বিষয়টা দেখছি,
দেখি ব্যাটারা কত দূর যায়, আর কী কী করে ঘোড়ার ডিম!
তবে পুলিশের এই নির্যাতনের কথা আজ বিশ্বজুড়ে স্বীকৃত!
ওরা আসলেই আর মানুষ নেই, মস্তিষ্কবিকৃত!


http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-06-04/news/262989

শুক্রবার, ১১ মে, ২০১২

সরকারের তাহলে ভয় কিসের!!!

ভারতের অর্থমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি এক নতুন সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, ভারত বাংলাদেশের সঙ্গে বন্ধুত্ব চায়, কোনো বিশেষ দলের সঙ্গে নয়। তিনি বিরোধী দলের নেত্রী খালেদা জিয়াকে ভারত সফরেরও আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। প্রণবের প্রথম বাংলাদেশ সফরকালে যে শীতল মনোভাব বিএনপির প্রতি দেখানো হয়েছিল, তার পরিপ্রেক্ষিতে এসব পরিবর্তন তাৎপর্যপূর্ণ।
প্রণব, হিলারি এবং সবশেষে ইউরোপীয় ইউনিয়ন আগামী নির্বাচন প্রসঙ্গে দুটো বিষয়ের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছে। এক. রাজনৈতিক সমঝোতা এবং দুই. সবার অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। দুটো বিষয়ের মূল লক্ষ্য অভিন্ন: তা হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে আগামী নির্বাচন অনুষ্ঠান। বাংলাদেশে এখন যত রকম রাজনৈতিক হানাহানি হচ্ছে, তার মূলেও রয়েছে তত্ত্বাবধায়ক সরকার রাখা না-রাখা নিয়ে বিরোধ।
অশক্ত গণতন্ত্রের একটি দেশ হিসেবে এই বিরোধ অস্বাভাবিক নয়। এ ধরনের দেশে শাসকগোষ্ঠী ‘অলটেরোকেসি’ বা ক্ষমতার পরিবর্তনে বিশ্বাস করে না। নির্বাচনে কারচুপি যতভাবে করা সম্ভব, তার মাধ্যমে জনগণের রায়কে ছিনতাই করার চেষ্টা এসব দেশে থাকে। বাংলাদেশে এটি চরম পর্যায়ে চলে গিয়েছিল বলে নির্বাচন অনুষ্ঠানের দায়িত্ব অরাজনৈতিক কিছু নাগরিকের কাছে প্রদান করার জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকার গঠনের রাজনৈতিক সমঝোতা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সেই সমঝোতাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা সম্ভবত সফল হবে না। আন্তর্জাতিক মহলও সে রকম ইঙ্গিত দিয়ে যাচ্ছে এখন পর্যন্ত।

২.
গণতন্ত্র মানে যদি হয় জনগণের ম্যান্ডেট, সে ম্যান্ডেট তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে এখনো রয়েছে। জাতীয় পার্টি ছাড়া বাংলাদেশের প্রতিটি বড় রাজনৈতিক দল এই সরকারব্যবস্থার পক্ষে ছিল। জাতীয় পার্টির নেতারা ১৯৯১ সালে অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতে সংগত কারণে এর বিরুদ্ধে কথা বলেছিলেন। সেই দলের নেতা এরশাদ পর্যন্ত জনগণ চাচ্ছে বলে তাঁর দল তত্ত্বাবধায়ক সরকারে রাজি আছে বলেছেন সাম্প্রতিক কালে।
তত্ত্বাবধায়ক সরকার নিয়ে দেশে এত সংঘাত হওয়ারও কথা ছিল না। সরকারে থাকা অবস্থায় ২০১০ সালে সংসদীয় কমিটির সঙ্গে সংলাপে স্বয়ং শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সংস্কার সাপেক্ষে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে মতামত জানিয়েছে। শেখ হাসিনা নিজে ১৯৯১ সালের নির্দলীয় সরকার, পরের দুটো তত্ত্বাবধায়ক সরকার এবং ২০০৭ সালের ‘অস্বাভাবিক’ তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার পেছনে অগ্রণী ভূমিকা রেখেছিলেন। তাঁর এই অবস্থানে পরে বিচ্যুতি না ঘটলে তত্ত্বাবধায়ক সরকার থাকবে কি থাকবে না তা নিয়ে দেশে কোনো সংঘাত সৃষ্টির কারণ হয়তো থাকত না।
প্রশ্ন হচ্ছে, আওয়ামী লীগ কেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারে এখন রাজি নয়? এর সহজ উত্তর হতে পারে নির্বাচনে হেরে যাওয়ার প্রবল ভীতি। বিদেশি ‘বন্ধুরা’ সামনের সময়ে হয়তো আরও স্পষ্ট করে বলবেন, দেশে এখনি ড. কামাল হোসেন, ড. ইউনূস, ড. আবেদের মতো বিশ্ববরেণ্য ব্যক্তি থেকে অধিকাংশ সাধারণ মানুষ (প্রথম আলোর ৯ মের জরিপ অনুসারে ৯০ দশমিক ১৯ শতাংশ) বলছেন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের পক্ষে। সুপ্রিম কোর্টের যে আদেশের খণ্ডিত ও একপেশে প্রয়োগ করে সরকার তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলোপকে যৌক্তিক করতে চায়, সেখানেও জনগণ এবং রাষ্ট্রের নিরাপত্তার স্বার্থে আগামী দুটো নির্বাচন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে অনুষ্ঠিত করার নির্দেশনা দেওয়া আছে। আওয়ামী লীগ তবু রাজি নয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারে। সর্বশেষ যা খবর, এ নিয়ে এমনকি কোনো সংলাপে বসতেও রাজি নয় দলটি।
সরকারি দলের কেন এই অনড় অবস্থান? একটি সফল সরকারের তো সুষ্ঠু নির্বাচনের প্রতি ভীতি থাকার কথা নয়। আমরা পত্রিকায় দেখি, সরকারের মন্ত্রীরা সবাই নিজেকে সফল ভাবেন। প্রধানমন্ত্রী নিজেই বলেন, চালচলনে সবাই স্যুটেড-বুটেড না হলেও তাঁর সব মন্ত্রীই সফল। আজকের পত্রিকায় দেখি, দেশে এমন এক গুম আতঙ্কে গুমোট সময়ে সাহারা খাতুন বললেন: তিনি অবশ্যই সফল!
আবারও বলি, এত সফল একটি সরকারের তো নিরপেক্ষ নির্বাচনে ভয় পাওয়ার কথা নয়! তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে এর আগে মহাব্যর্থ কিছু সরকার অংশ নিয়েছিল। তারা প্রত্যেকেই পরাজিত হয়েছিল। গত বিএনপি সরকারের ভরাডুবিই ঘটেছিল ২০০৮ এর নির্বাচনে। আওয়ামী লীগ কি নিজেদের ব্যর্থতার কারণে এমন পরিণতির আশঙ্কা করছে? একমাত্র এই আশঙ্কা থাকলেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে তাদের প্রবল বিরোধিতা আমাদের কাছে বোধগম্য হতো।
কিন্তু আমরা প্রকাশ্যে তাদের কোনো ব্যর্থতা স্বীকার করতে দেখি না। এ জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিরোধিতার ক্ষেত্রে তাদের মনস্তত্ত্ব আরও দুর্বোধ্য হয়ে পড়ছে।

৩.
প্রকাশ্যে আমরা আওয়ামী লীগকে বলতে শুনি শুধু তাদের সফলতার কথা। এর কারণ হতে পারে এই যে, সাধারণ মানুষ যেভাবে সফলতার মানে বোঝে, তার চেয়ে সরকারি দলগুলোর বোঝাটার ভঙ্গিটি ভিন্ন ধরনের। যেমন: আমরা যখন ইলিয়াসের গুম হওয়া নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করছি, সরকারের লোকজন হয়তো ভাবছেন ড. কিবরিয়া বা আহসানউল্লাহ মাস্টারের হত্যাকাণ্ডের তুলনায় এটি তেমন কোনো বিষয় নয়। আমরা যখন ড. ইউনূসের অপমানে দেশের মর্যাদা ক্ষুণ্ন হয়েছে ভাবি, তাঁরা হয়তো ভাবেন প্রধানমন্ত্রীর শান্তির মডেল উত্থাপন বাংলাদেশকে নিয়ে গেছে নতুন উচ্চতায়! আমরা যখন নদী শুকিয়ে যাচ্ছে বলে হাহাকার করে উঠি, তাঁরা হয়তো ভাবেন সমুদ্রজয়ের পানি দিয়ে সমাধান হয়ে যাবে সব সমস্যার। আমরা যখন কর্মসংস্থান বা বিনিয়োগ-পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বিগ্ন হই, তাঁরা তখন শুধু জিডিপির গতি দেখেই তৃপ্ত থাকেন।
আমাদের চেয়ে তাঁদের দেখার চোখ ভিন্ন। দলীয়করণকে তাঁরা হয়তো ভাবেন ‘মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের’ লোকের মূল্যায়ন, দুর্নীতিকে ভাবেন দেশসেবার কারণে অর্জিত অধিকার বা ধনতন্ত্রের জন্য মূলধন পুঞ্জীভূতকরণ, রাজনৈতিক সন্ত্রাসকে ভাবেন মহৎ প্রতিশোধ, শেয়ারবাজার লুট করাকে ভাবেন চতুর মানুষের অর্জন, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি মানে ভাবেন বাজার অর্থনীতি!
সরকারি দল নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো করে শুধু নির্বাচনে জেতার জন্য, আমরা ভুল করে ভাবি তা বাস্তবায়নের জন্য। সরকারি দল দিনবদল মানে ভাবে শাসকগোষ্ঠী আর তার অনুগতদের দিনবদল, আমরা ভাবি সবার জন্য দিনবদল। সরকার ভাবে দেশটা সরকারি দলের, আমরা ভাবি জনগণের। সরকার ভাবে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক মানে ভারত, আমরা ভাবি অন্যরাও।
বোঝার ক্ষেত্রে এই মনস্তাত্ত্বিক পার্থক্য সত্যি না হলে সরকার আর আমাদের মূল্যায়ন এত ভিন্ন হওয়ার কারণ নেই। আমার কথা হচ্ছে, সরকারের আত্মমূল্যায়ন সঠিক হলে সুষ্ঠু আর অবাধ নির্বাচনে তাদের ভয় পাওয়ার কারণ নেই। আর এমন নির্বাচন কেবল তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনেই হওয়া সম্ভব।

৪.
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রতি অনীহার একটি কারণ আমরা সরকারের নীতিনির্ধারকদের মুখে শুনি। তাঁরা ১/১১ পরবর্তী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রসঙ্গ টেনে সে সময় রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও আমলাদের প্রতি নিপীড়নের কথা বলেন। এই অভিযোগ অমূলক নয়। তত্ত্বাবধায়ক সরকার যে সংবিধান-বহির্ভূতভাবে বহুদিন ক্ষমতায় ছিল, এটিও সত্যি। কিন্তু আমাদের মনে রাখতে হবে, সেই তত্ত্বাবধায়ক সরকার ছিল একটি অস্বাভাবিক পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিকভাবে সৃষ্ট একটি সরকার। এ ধরনের পরিস্থিতির মূল কারণ ছিল বিএনপি কর্তৃক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মোড়কে একটি অনুগত নির্বাচন প্রশাসন ও নির্বাচনী প্রক্রিয়া স্থাপনের চেষ্টা। সেই চেষ্টা সহিংসভাবে ঠেকাতে গিয়েছিল তৎকালীন বিরোধী দল, এর পরিণতিতে সৃষ্ট অস্বাভাবিক তত্ত্বাবধায়ক সরকারকে সদলবলে অভিনন্দিত করেছিলেন দলটির সভানেত্রী। একইভাবে বর্তমান সরকারি দলও কারসাজির নির্বাচন করতে গেলে তা যেকোনো মূল্যে বর্তমান বিরোধী দল প্রতিহত করার চেষ্টা করবে, এটাই স্বাভাবিক।
এই অনিবার্য সংঘাত এড়ানোর একমাত্র সমাধান হচ্ছে তত্ত্বাবধায়ক সরকারব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন (এবং ২০০৬ সালের মতো তা টেম্পারিং করার চেষ্টা না করা)। এ জন্য দেশি-বিদেশি বিভিন্ন মহল সংলাপের প্রয়োজনীয়তার কথা বলছে। কিন্তু আমার মতে, সরকার নিজে থেকে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিলে সংলাপেরও তেমন প্রয়োজন নেই। এই উদ্যোগের ভিত্তিতে সংসদে বিস্তারিত আলোচনার সুযোগ দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের যে ত্রুটিগুলো রয়েছে (যেমন: এর গঠন, কার্যকাল এবং ক্ষমতাসংক্রান্ত), তা দূর করে সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য নির্বাচনকালীন একটি সরকার প্রতিষ্ঠা করা অসম্ভব নয়।
এ জন্য অতিকেন্দ্রীভূত বর্তমান সরকারব্যবস্থায় সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন সরকারপ্রধানের সদিচ্ছা। এই সদিচ্ছার অভাব ছিল বলে অতীতে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের কোনো নজির আমরা পাইনি। গত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের শেষ দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কিছু সফল সংলাপ হয়েছিল। কিন্তু ৯০-পরবর্তী গণতন্ত্র পুনরুত্থানের যুগে সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নজির সম্ভবত আর নেই। বর্তমান সরকারের আমলে সংবিধান সংশোধনী সংক্রান্ত সংলাপে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রয়োজনীয়তাসহ বহু বিষয়ে মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। সরকার সেই মতৈক্যের গুরুত্ব অধিকাংশ ক্ষেত্রে প্রদান করেনি। এটি প্রমাণ করে, সরকারপ্রধান না চাইলে রাজনৈতিক সংলাপের মাধ্যমে প্রকৃত সমাধানের সম্ভাবনা তেমন নেই বাংলাদেশে।
আমরা সেই সদিচ্ছার প্রত্যাশা করি। দলীয় সরকারের মাধ্যমে একতরফা নির্বাচন বাংলাদেশে অতীতে হয়েছে। আমাদের অভিজ্ঞতা বলে, এমন নির্বাচনগুলো হয়েছে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হওয়ার ভয় থেকে। আগামী নির্বাচনও এভাবে করার উদ্যোগ নিলে মানুষ সেই ভয়ের গন্ধ পাবে। আমার মনে হয় না, জনগণকে ভয় পেয়ে বা ভয় দেখিয়ে বাংলাদেশে ক্ষমতায় টিকে থাকা যায়।
জনগণের সঙ্গে এমন ভয়ের সম্পর্ক যদি না থাকে, তাহলে জনগণের প্রত্যাশা অনুসারে তত্ত্বাবধায়ক সরকার পুনঃপ্রবর্তনে সরকারের রাজি হওয়া উচিত। সেটি যত তাড়াতাড়ি হবে, ততই মঙ্গলজনক।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।


http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-05-11/news/256731

রবিবার, ২৯ এপ্রিল, ২০১২

20 essential PC shortcuts

  • Copy a selected item: Ctrl+C
  • Cut a selected item: Ctrl+X
  • Paste a selected item: Ctrl+V
  • Undo an action: Ctrl+Z
  • Redo that thing I just undid: Ctrl+Y
  • Select everything: Ctrl+A
  • Print: Ctrl+P 
    • Switch between open windows
    Alt+Tab 
    •  Clear away everything and show the desktop
    Windows logo key Picture of the Windows logo key+D 
    •  Minimize the window
    Windows logo key Picture of the Windows logo key+Down Arrow
    •   Maximize the window
    Windows logo key Picture of the Windows logo key+Up Arrow
    •  Compare and contrast in a snap
    Windows logo key Picture of the Windows logo key+Left Arrow or Right Arrow
    •  Multitask with multiple monitors
    Windows logo key Picture of the Windows logo key+Shift+Right Arrow or Left Arrow
    •  Open Task Manager
    Ctrl+Shift+Esc
    •  Choose a presentation display mode
      Windows logo key Picture of the Windows logo key+P
    •  Zoom in, zoom out
    Windows logo key Picture of the Windows logo key+Plus Sign or Minus Sign
  •  Search for files and folders
    Windows logo key Picture of the Windows logo key+F
    •  Open a new instance of a program
      Windows logo key Picture of the Windows logo key+Shift+Click a taskbar icon
    •  And when you need it...get help
      Windows logo key Picture of the Windows logo key+F1
     

শুক্রবার, ২৭ এপ্রিল, ২০১২

রাষ্ট্রপতির ক্ষমার বৈধতা!

রাষ্ট্রপতির ক্ষমায় দণ্ড মওকুফ পাওয়া ব্যক্তিকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ প্রদানের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের সুপ্রিম কোর্ট একটি নতুন আইনি ধারা উন্মোচন করলেন। ৪০ বছর ধরে আমাদের ধারণা দেওয়া হয়েছিল যে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় নেওয়া সিদ্ধান্ত ধরাছোঁয়ার বাইরে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমার এখতিয়ারের অপব্যবহারের গুরুতর অভিযোগ গণমাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে। সম্ভবত এটাই প্রথম রায়, যেখানে পরোক্ষভাবে হলেও প্রমাণিত হলো যে ৪৯ অনুচ্ছেদ দেখিয়ে রাষ্ট্রপতির সিদ্ধান্তে আদালতের নজরদারি রহিত করা যাবে না। তাই এই রায় একটা বিরাট বিচারিক অগ্রগতি।
বিচারপতি এম ইনায়েতুর রহিম ও বিচারপতি শেখ মো. জাকির হোসেনের সমন্বয়ে গঠিত বেঞ্চ ২৫ এপ্রিল প্রায় ১৯ বছর আগে তথ্য গোপন করে রাষ্ট্রপতির কাছ থেকে পাওয়া ক্ষমা উল্টে দিয়েছেন। দণ্ডিতকে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দিয়েছেন। এই রায়ের মধ্য দিয়ে সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদের আওতায় রাষ্ট্রপতির বিশেষ অধিকারও বিচার বিভাগীয় এখতিয়ারভুক্ত।
মনে করা হয়, একজন বিচারক যতই প্রশিক্ষিত ও দক্ষ হোন না কেন, এমন বিরল মুহূর্ত আসতে পারে, যখন তিনি হয়তো কাউকে ভুলভাবে দণ্ড দিলেন। নাগরিকের জীবন ও ব্যক্তিস্বাধীনতা রক্ষার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে কারণে ক্ষমা বা দণ্ড হ্রাসের সুযোগ রাখা হয়েছে। বাংলাদেশে এর অপব্যবহার চলছে। একজন পলাতক আইনের আশ্রয়লাভের অধিকারী নন। কক্সবাজারের ওই মামলায়ও দণ্ডিত ব্যক্তি রাষ্ট্রপতির দণ্ড মওকুফের সময় আইনের দৃষ্টিতে পলাতক ছিলেন।
বিচার বিভাগ নিয়ে যাঁরা সক্রিয় ভূমিকা রাখেন, আমরা তাঁদের দৃষ্টি আকর্ষণ করি। এই মামলায় হাইকোর্টের বেঞ্চ হয়তো তাঁদের এখতিয়ার নিয়ে দ্বিধান্বিত ছিলেন। কারণ, তাঁদেরটি রিট বেঞ্চ ছিল না, ছিল ফৌজদারি কার্যবিধিনির্ভর। সে কারণে ৪৯ অনুচ্ছেদ নিয়ে যে ধরনের পূর্ণাঙ্গ ও বিস্তারিত রায় ও নির্দেশনা আমরা আশা করেছি, সেটা হয়তো পুরোমাত্রায় অর্জিত না-ও হতে পারে। কিন্তু কোনো রিট বেঞ্চে জনস্বার্থে মামলা হলে আমরা তা পাওয়ার আশা করতে পারি।
ওই মামলার নথি নিখোঁজ। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি আবদুর রহমান বিশ্বাস কীভাবে, কী সুপারিশ করেছিলেন, তা অজানা। আমরা আশঙ্কা করি, এটি বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়। আদালত অবমাননার দায়ে অভিযুক্ত কর্মকর্তারা নথি খোয়ানোর জন্য নিঃশর্ত ক্ষমা চেয়ে পার পেয়েছেন। কিন্তু জনগণের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা কমেনি। গত ৪০ বছরে কতজন ক্ষমা পেয়েছেন এবং তার নথি ব্যবস্থাপনার কী হাল, তা আমরা সরকারের কাছে জানতে চাই।
ফাঁসির আসামি ঝিন্টু এবং লক্ষ্মীপুরের আওয়ামী লীগের নেতা আবু তাহেরের ছেলের দণ্ড মওকুফের বৈধতা সন্দেহাতীতভাবে আদালতে চ্যালেঞ্জযোগ্য। আমরা আশা করব, এই রায়ের আলোকে সংশ্লিষ্ট সচেতন মহল এর প্রতিকার চাইতে আদালতের শরণাপন্ন হবে। এই মাইলফলক রায় প্রমাণ করেছে, সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদকে যান্ত্রিকভাবে ব্যবহার করা যাবে না। উত্তম নজির হিসেবে এ রায়টি অনুসরণীয় হোক।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-04-27/news/253341

বুধবার, ২৫ এপ্রিল, ২০১২

চীনা সেনার নিয়ন্ত্রণ কার হাতে?

পিপলস লিবারেশন আর্মির কয়েকজন সদস্য পিপলস লিবারেশন আর্মির কয়েকজন সদস্য
ছবি: রয়টার্স
চীনের বিপুল অস্ত্র ও বিশাল সেনাবাহিনী আসলে কার নিয়ন্ত্রণে? আন্তর্জাতিক মহলে এ আগ্রহ অনেকের। কে বা কারা চীনের বন্দুক ও যুদ্ধজাহাজ নিয়ন্ত্রণ করছে, সেটা পরিষ্কার করলে ক্রমবর্ধমান এই সেনাবাহিনী নিয়ে বাইরের মানুষের ভয় থাকত না। পরাশক্তিগুলোর মধ্যে একমাত্র চীনেই পিপলস লিবারেশন আর্মি (পিএলএ) নামে একটা সশস্ত্র সংগঠন রয়েছে, যেটা আনুষ্ঠানিকভাবে রাষ্ট্রের কোনো অংশের মধ্যে পড়ে না। এটা কেবল সে দেশের কমিউনিস্ট পার্টির কাছে দায়ী। প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয় নয়, বরং পার্টির কেন্দ্রীয় সেনা কমিশন নিয়ন্ত্রণ করে সেনাবাহিনীকে। যদিও চীনে কাজে-কর্মে ক্ষমতাসীন পার্টি ও সরকার প্রায় কাছাকাছি, তার পরও পার্টির কাজকর্ম বেশ দুর্বোধ্য। এই পার্টিই পিএলএর বিষয়টি ঘোলাটে করে রেখেছে।
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের সেনাবাহিনীর মধ্যকার সুসম্পর্ক এই দুর্বোধ্যতা দূরীকরণে সহায়ক হতে পারে। কিন্তু তাইওয়ানের বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে উত্তেজনা বিরাজ করলে পিএলএ শাস্তিস্বরূপ দুই দেশের সেনাবাহিনীর মধ্যকার যোগাযোগ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া দুই দেশের সেনাদের সম্পর্ক গভীর হলে মার্কিনিরা আবার লাভবান হয় কি না, সে বিষয়েও পিএলএ উদ্বিগ্ন থাকে। তাই এসব নানা অনিশ্চিত সম্ভাবনা মাথায় নিয়ে কেউ মনে করতে পারেন, চীনের অবস্থান শান্তির পক্ষে। আবার কেউ কেউ এর উল্টোও ভাবতে পারেন। যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী থিংক-ট্যাংক, দ্য সেন্টার ফর স্ট্র্যাটেজিক অ্যান্ড বাজেটারি অ্যাসেসমেন্টস (সিএসবিএ) বলছে, চীনের মতো একটি কর্তৃত্ববাদী সরকার মুহূর্তেই মত পাল্টাতে পারে।
অনেক দিন আগে থেকেই চীন তার সামরিক শক্তি বাড়ানোর কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। ১৯৫০-এর দশকে দেশটি প্রথম এ কাজে হাত লাগায়। সে সময় সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়ন ছিল তার অন্যতম প্রধান মিত্র ও অস্ত্র সরবরাহকারী। কিন্তু ষাটের দশকের মাঝামাঝি সময়ে মাও সেতুংয়ের দশকব্যাপী সাংস্কৃতিক অভ্যুত্থানের সময় সামরিক শক্তি বাড়ানোর কাজটি অপ্রত্যাশিতভাবে বন্ধ হয়ে যায়। বিতর্কিত সীমানা নিয়ে দেশ দুটির মধ্যে প্রায় যুদ্ধ বেধে যাচ্ছিল এবং ঠিক তখনই চীন প্রথম সফলভাবে তার পারমাণবিক পরীক্ষা চালায়। আশির দশকে দেং শিয়াও পেংয়ের নেতৃত্বে সামরিক শক্তি আধুনিকায়নের দ্বিতীয় পর্যায় শুরু হয়। দেং চেয়েছিলেন পুরো দেশকেই ঢেলে সাজাতে। সেখানে বাদ যায়নি সেনাবাহিনীও। কিন্তু তিনি পিএলএকে বলেছিলেন, দেশের অর্থনীতিই তাঁর সরকারের প্রথম পছন্দ এবং জেনারেলদের অবশ্যই জিডিপির ১.৫ শতাংশ বাজেট নিয়ে সন্তুষ্ট থাকতে হবে।
নব্বই দশকের গোড়ার দিকে আধুনিকায়নের তৃতীয় পর্যায় শুরু হয়। ১৯৯১ সালে প্রথম উপসাগরীয় যুদ্ধে ইরাকের ওপর পশ্চিমা বিশ্বের উচ্চপ্রযুক্তির ধ্বংসাত্মক মারণাস্ত্রের মারাত্মক প্রভাব দেখে চীন উপলব্ধি করে, সম্মুখযুদ্ধ তথা স্থলযুদ্ধের দিন শেষ।
পিএলএর বিশেষজ্ঞরা বেইজিংয়ের অ্যাকাডেমি অব মিলিটারি সায়েন্সে বসে মার্কিন থিংক-ট্যাংকদের প্রবর্তিত তথাকথিত ‘রেভল্যুশন ইন মিলিটারি অ্যাফেয়ার্স’ (আরএমএ) বিষয়ে ব্যাপক পড়াশোনা করতে থাকেন। আরএমএ হলো কম্পিউটার-নিয়ন্ত্রিত কৌশল এবং অস্ত্রশস্ত্রের অভূতপূর্ব উন্নয়ন সাধন। বেইজিংয়ের ওই অ্যাকাডেমিতে অতি সম্প্রতি প্রতিরক্ষা-বিষয়ক প্রধান চারটি শ্বেতপত্রের প্রণেতা জেনারেল চেন ঝোউ লন্ডনের দ্য ইকোনমিস্ট পত্রিকাকে বলেছেন, ‘আমরা পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে আরএমএ পড়েছি। আমাদের কাছে মহানায়ক হলেন অ্যান্ডি মার্শাল, যিনি পেন্টাগনের প্রধান ভবিষ্যবাদী হিসেবে পরিচিত। আমরা তাঁর লেখা প্রতিটি শব্দ অনুবাদ করে পড়েছি।’
১৯৯৩ সালে চীনের কমিউনিস্ট পার্টির সে সময়ের সাধারণ সম্পাদক জিয়াং জেমিন আরএমএকে দেশটির সামরিক কৌশলের কেন্দ্রে স্থাপন করেন। যার ফলে এখন পিএলএ অনুভব করছে, উচ্চপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তারা আঞ্চলিক যেকোনো যুদ্ধে সফল হতে পারে। দেশটির ব্যয়বহুল সামরিক খাতের বাজেটের বেশির ভাগ গেছে এখন পর্যন্ত বিমান, নৌ ও গোলন্দাজ বাহিনীর পেছনে, যারা কিনা চীনের পারমাণবিক ও প্রথাগত ক্ষেপণাস্ত্র পরিচালনা করে।
২০০২ ও ২০০৪ সালের দিকে আরও উন্নয়ন ঘটে সামরিক শক্তির আধুনিকায়নে। জেনারেল চেন বলেন, ২০১০ সাল পর্যন্ত আধুনিক সশস্ত্র বাহিনীর ভিত গঠন করা হয়েছে। পরবর্তী দশকে তাদের সমন্বিত কার্যকলাপ দেখা যাবে। যেখানে থাকবে কমান্ড, কন্ট্রোল, কমিউনিকেশনস ও কম্পিউটারের সমন্বয়ে সম্মিলিত নেটওয়ার্ক। ২০২০ সালের মধ্যেই চীনের সেনাবাহিনী এ লক্ষ্য অর্জন করতে যাচ্ছে। তবে চেন স্বীকার করেন, পশ্চিমাদের মতো স্বয়ংসম্পূর্ণ শক্তি অর্জন করতে তাদের আরও কিছু সময় লাগতে পারে। তার পরও ২০১০ সালে সিএসবিএ জানায়, আগামী ১০ বছরের মধ্যেই চীন প্রয়োজনীয় বেশকিছু সামরিক সরঞ্জামের অধিকারী হতে যাচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে, শত্রুপক্ষের গতিবিধি পর্যবেক্ষণের জন্য স্যাটেলাইট ও গোপন প্রযুক্তি, ভূমি থেকে ভূমিতে নিক্ষেপযোগ্য ও জাহাজবিধ্বংসী হাজারো ক্ষেপণাস্ত্র, ৬০টিরও বেশি গোপন ডুবোজাহাজ, কমপক্ষে ছয়টি পারমাণবিক শক্তিসমৃদ্ধ ডুবোজাহাজ, চালকসহ ও চালকবিহীন গোপন যুদ্ধবিমান। এ ছাড়া আগামী তিন থেকে পাঁচ বছরের মধ্যে আকারে ছোট হলেও বিমানবাহী কয়েকটি রণতরীও সমুদ্রে ভাসাতে যাচ্ছে। যদিও সামরিক বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এগুলো রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচালনার জন্য দেশটিকে আরও বেশ কয়েক বছর চেষ্টা করতে হবে।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-04-24/news/252707

শনিবার, ১৪ এপ্রিল, ২০১২

ঈশ্বরের সন্ধানে!!!

আলম সাহেব। কাজী আলম তালুকার। একজন জনপ্রিয় রাজনীতিবিদ। তার দলের লোকদের কাছে তিনি জনপ্রিয়। তবে এলাকার লোকজনদের কাছে তিনি ‘ধনপ্রিয়’, মানে ধনসম্পদের দিকে তার প্রচুর আগ্রহ এবং এ কারণে তিনি এখন প্রাইভেট ব্যাংক, পত্রিকা, চ্যানেলের মালিক আর গার্মেন্ট ইত্যাদির তো কোনো হিসাব নেই। সবই ঠিক ছিল, কিন্তু হঠাত্ করে তিনি আবিষ্কার করলেন তার গলার কাছে সব সময় কেমন যেন আইঢাই করে! একদিন তিনি গেলেন এক নাক-গলা বিশেষজ্ঞের কাছে। এই বিশেষজ্ঞের অ্যাপয়েন্টমেন্ট পেতে তিনদিন লাগে। তবে আলম সাহেবের ব্যাপার আলাদা। তিনি ঠিকই তার প্রভাব খাটিয়ে অ্যাপয়েন্টমেন্ট জোগাড় করলেন। গেলেন একদিন ডাক্তারের কাছে।
-কি সমস্যা? বুড়ো ডাক্তার ভ্রূ কুঁচকে তাকালেন তার দিকে
-সমস্যাটা গলায়।
-কি রকম সমস্যা?
-মানে গলার কাছে সবসময় কেমন আইঢাই করে।
-আইঢাই কি?
-মানে কিছু একটা আটকে আছে এমন একটা ভাব...
-হুম... বুড়ো বিশেষজ্ঞ নাক-কান-গলার ডাক্তার ছোট্ট একটা টর্চ দিয়ে গলার ভেতরটা দেখার চেষ্টা করলেন। গলা টিপে-টুপে দেখলেন। তার খাওয়া-দাওয়া নিয়ে কিছু প্রশ্ন করলেন, তারপর বললেন—
-আপনার রোগটা ধরতে পেরেছি।
-কি রোগ ডাক্তার সাহেব?
-এটাকে বলে খাই খাই রোগ।
-মানে? এবার আলম সাহেবের ভ্রূ জোড়া কুঁচকে যায়।
-বুঝলেন না? আপনি তো রাজনীতি করা লোক, তাই না? দেশের জনপ্রিয নেতা। অনেক খেয়েছেন... এতই বেশি খেযেছেন যে, গলার কাছে এখন সব আটকে গিয়ে আপনার ভাষায় গলা আইঢাই করছে।
-কি বলছেন এসব?
-ঠিকই বলছি... আপনার আসলে গলায় কোনো রোগ নেই... মানসিক রোগ... সারাজীবন খাই খাই রাজনীতি করেছেন, এখন তার ফল এই আইঢাই...
বাড়ি ফিরে এসে আলম সাহেবের মনে হলো গলার আইঢাই ভাবটা আরও বেড়েছে। এর মানে কি? তবে ডাক্তার ঠিকই বলেছেন। সে রাতে তিনি ভালো করে ঘুমুতে পারলেন না। এপাশ-ওপাশ করলেন শুধু। একপর্যায়ে স্ত্রী বিরক্ত হয়ে বলেই ফেললেন, ‘কি হলো বিছানায় শুয়ে লাট্টু’র মতো ঘুরছো কেন?
-লাট্টুর মতো ঘুরছো মানে?
-তাই তো ঘুরছো... দেশের মানুষকেও ঘোরাও, ইদানীং দেখছি নিজেও ঘুরছো... আরও কি সব বলে গজগজ করতে করতে ঘুমিয়ে গেলেন স্ত্রী। তিনি জনগণকে লাট্টুর মতো ঘুরান? স্ত্রীর বাক্যটা যেন ঘৃতে অগ্নিসংযোগ ঘটাল, তার মাথার ভেতরটা গরম হয়ে গেল, তার ইচ্ছে হলো স্ত্রীকে কয়েকটা কড়া কথা বলবেন—তা না বলে তিনি উঠে বসলেন। বিছানা থেকে নেমে ড্রইংরুমে গিয়ে বসলেন। তারপর কি মনে করে দরজা খুলে নিঃশব্দে গেটের কাছে এসে দেখেন, কম বয়সী দারোয়ান ছেলেটা টুলে বসে আছে। তিনি আশা করেছিলেন, এসে দেখবেন দারোয়ান ছেলেটা ঘুমুচ্ছে এবং একটা ধমক দেবেন। স্ত্রীর ওপর রাগটা ওর ওপর ঝাড়বেন। কিন্তু ছেলে জেগে আছে। তাকে দেখে টুল থেকে উঠে দাঁড়িয়ে সালাম দিল। রাত তখন আড়াইটা।
-তুমি রাতে ঘুমাও না?
-জি না স্যার।
-সত্যি ঘুমাও না?
-না স্যার। রাতে ঘুমালে ডিউটি হবে কেমনে?
আলম সাহেবের হঠাত্ মনে হলো এই বাচ্চা ছেলেটা যার বেতন মাত্র এক হাজার টাকা, সে তার বাড়ি পাহারা দেয় রাত জেগে আর তিনি ভেতরে এসির মধ্যে ঘুমান!
-যাও তুমি আজ ঘুমাতে যাও, আমি এখানে বসি।
-কি বলছেন স্যার? আপনি এই টুলে বসবেন?
-হ্যাঁ যাও... তুমি আজ ঘুমাও। আমার বাড়ি আজ আমিই পাহারা দেই। ছেলেটি অস্বস্তি নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে, আর শক্ত টুলটায় তিনি সত্যি সত্যি বসেন।
-কি হলো, যাও বলছি।
দারোয়ান ছেলেটি কিছুক্ষণ হতভম্ব হয়ে দাঁড়িয়ে থাকল। তারপর চলে গেল। টুলে বসে থাকলেন দেশের জনপ্রিয় নেতা কাজী আলম তালুকদার। ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। আকাশে গোল একটা চাঁদ। গলার কাছটা আইঢাই করছে। তিনি কি সত্যিই বেশি খেয়ে ফেলেছেন?... আর তখনই তিনি একটা ভয়ঙ্কর সিদ্ধান্ত নিলেন। তিনি যা খেয়েছেন, সব উগরে দিবেন। হ্যাঁ, কালই তিনি সব উগরে দিবেন। সত্যিই দিবেন।
সারা দেশে হইচই। দেশের জনপ্রিয় নেতা কাজী আলম তালুকদার তার সব সম্পদ রাষ্ট্রকে বুঝিয়ে দিয়ে দেশ ছেড়ে হিমালয়ের দিকে রওনা দিয়েছেন। খবর পেয়ে দেশের ঊনত্রিশটা চ্যানেল ছুটে এলো।
-স্যার, আপনি সত্যিই হিমালয়ের গুহায় চলে যাচ্ছেন সব ত্যাগ করে?
-হ্যাঁ, সত্যি।
-কিন্তু কেন স্যার?
-আমি হিমালয়ের গুহায় বসে ঈশ্বরের সন্ধান করব।
-এতদিন তাহলে কিসের সন্ধান করেছেন?
-এতদিন সম্পদের পেছনে ছুটেছি... জনগণকে ধোঁকা দিয়েছি, লাট্টুর মতো ওদের ঘুরিয়েছি... তাই হঠাত্ ঠিক করলাম...
-আপনার এই বোধোদয় হওয়ার কারণ?
-কোনো কারণ নেই, আমার গলার কাছটা আইঢাই করত... তারপর...
ঊনত্রিশ চ্যানেলকে বিদায় করে... বর্ডার ক্রস করে, বহু কাঠখড় পুড়িয়ে অবশেষে তিনি উপস্থিত হলেন হিমালয়ের এক গুহায়। সেখানে আগে থেকেই এক সাধু বসে আছে। সাধুর সামনে একটা ল্যাপটপ!
-কি চাস এখানে? সাধু হুঙ্কার দিল।
-জি আমি ইশ্বরের সন্ধানে এসেছি।
-ওরে বোকা ঈশ্বরের সন্ধান পাওয়া এত সোজা? আমি কত বছর ধরে চেষ্টা করছি... এক্সেস ডিনাইড বলছে।
-কি বলেন? গুহায় বসে আপনি ল্যাপটপে ঈশ্বরকে খুঁজছেন?
-আরে ভাই টানা ১০ বছর ধ্যান করে দেখেছি লাভ হয়নি। তাই আধুনিক প্রযুক্তি দিয়ে চেষ্টা করছি... গড ডট কমে ঢুকে চেষ্টা করলাম অনেকক্ষণ, এক্সেস ডিনাইড বলছে। গুগলেও চেষ্টা করেছিলাম।
-জনাব আমার একটা প্রশ্ন ছিল।
-বলে ফেলুন।
-আপনি কেন গুহায় বসে ঈশ্বরের সন্ধান করছেন?
-আরে ভাই, আগে আমি ভালোই ছিলাম। বেশ ভালো ছিলাম... নিজের দেশে গাড়ি-বাড়ি, নারী, ফ্ল্যাট, গার্মেন্ট সবই ছিল... কিন্তু হঠাত্ আবিষ্কার করলাম গলার কাছটা কেমন আইঢাই করছে... তারপর...
-বুঝতে পেরেছি, আর বলতে হবে না।
কাজী আলম তালুকার ফিরে চলেছেন তার দেশে নিজ বাসভূমে। তিনি ঈশ্বরকে পেয়েছেন। তিনি বুঝতে পেরেছেন ঈশ্বর আসলে মানুষের ভেতরেই বাস করেন। তাকে খুঁজে পেতে হিমালয়ের গুহা জরুরি নয়। তিনি তার মানুষের কাছে ফিরে চললেন... তিনি টের পেলেন তার গলার ভেতর সেই আইঢাই ভাবটা আর নেই...! হ
 
আ হ সা ন হা বী ব.
 
http://www.amardeshonline.com/pages/details/2012/04/14/140894

শুক্রবার, ৩০ মার্চ, ২০১২

ভারতের দালাল (!), পাকিস্তানের দালাল (!)

বাংলাদেশের বড় দুটো দল নাকি প্রতিবেশী রাষ্ট্রের ‘দালাল’! আওয়ামী লীগকে বিএনপি ও তার মিত্ররা ভারতের সেবাদাস, ভারতের প্রতি নতজানু, ভারতের আজ্ঞাবাহী নামে অভিহিত করে থাকে। সম্প্রতি আওয়ামী লীগের মিত্র দুটো দলের (ওয়ার্কার্স পার্টি ও জাতীয় পার্টি) নেতারাও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার প্রভাবশালী উপদেষ্টাদের ভারতের হয়ে কথা বলার অভিযোগ করেছেন। বিএনপিকে আওয়ামী লীগ পাকিস্তানপন্থী বা আইএসআইয়ের এজেন্ট হিসেবে বর্ণনা করে। তার মিত্র দলগুলোর কোনো কোনো নেতাও একই কথা বলে থাকেন।
বাংলাদেশের রাজনীতি এখন উত্তাল হয়ে আছে এসব প্রসঙ্গে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নিজে এতে নিয়েছেন নেতৃস্থানীয় ভূমিকা। পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআই বিএনপিকে ১৯৯১ সালের নির্বাচনের সময় পাঁচ কোটি রুপি দিয়েছিল এই অসমর্থিত সংবাদ বাংলাদেশে প্রকাশিত হওয়ার পর তিনি এর ভিত্তিতে বিএনপি ও বিরোধী দলের নেত্রীকে আক্রমণ শুরু করেন। তিনি বিএনপির নেত্রী খালেদা জিয়াকে পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করে পাকিস্তানে চলে যাওয়ার পরামর্শ দেন এবং ‘আইএসআইয়ের টাকা খাওয়া’ বিএনপিকে আগামী নির্বাচনে ভোট না দিতে জনগণকে আহ্বান জানান।
বিএনপিকে আইএসআইয়ের টাকা দেওয়ার তথ্য প্রথম আসে খালিজ টাইমস-এ প্রকাশিত আফজাল খান নামের একজন সাংবাদিকের লেখায়। খালিজ টাইমস-এর লেখাটি অবলম্বনে একটি প্রতিবেদন প্রথম আলোতে প্রকাশিত হওয়ার পরপরই এ নিয়ে বিএনপিকে আক্রমণ করা শুরু হয়। যার বরাতে এই সংবাদ প্রকাশিত হয়েছিল সেই আসাদ দুররানি (আইএসআইয়ের সাবেক প্রধান) নিজে বিবিসি এবং বাংলাদেশের দুটো দৈনিককে জানান, তিনি এ ধরনের কোনো কথা পাকিস্তানের আদালতে বলেননি, পাকিস্তানের পররাষ্ট্র দপ্তরও টাকা দেওয়ার সংবাদের সত্যতা নাকচ করে। দেশের শীর্ষস্থানীয় ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার খালিজ টাইমস-এর সংবাদটি প্রকাশ করেছিল ২৭ মার্চ। তারা এ সংবাদটির সত্যতা এখন পর্যন্ত খুঁজে পাওয়া যায়নি বলে জানায় এবং এটি ছাপানোর জন্য দুঃখ প্রকাশ করে। প্রথম আলোর মশিউল আলম ২৮ মার্চের একটি লেখায় ‘অত্যন্ত স্পর্শকাতর’ এই সংবাদটি প্রকাশের আগে ‘সতর্কভাবে সম্ভাব্য সব উপায়ে তা আরও যাচাই করে দেখা প্রয়োজন ছিল’ বলে স্বীকার করেন।
এই বিতর্ক এখানেই শেষ হওয়ার কথা। কিন্তু বাংলাদেশের রাজনীতির যাঁরা নিবিড় পর্যবেক্ষক তাঁরা সম্ভবত জানেন, এটি থামবে না এখানে। এ ধরনের কাদা ছোড়াছুড়ি অব্যাহত থাকবে আরও বহুদিন। বিএনপি বলবে, ইকোনমিস্ট-এ ছাপা হয়েছে, ২০০৮-এর নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে বস্তা বস্তা টাকা দিয়েছিল ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা র। আওয়ামী লীগ বলবে, দেশি-বিদেশি পত্রিকায় ছাপা হয়েছে, আইএসআই টাকা দিয়েছিল বিএনপিকে।
প্রমাণহীন দোষারোপ ও চরিত্র হরণের রাজনীতি ইতিমধ্যেই দেশের মানুষকে যথেষ্ট বিপর্যস্ত করেছে। কে কার কোলে বসেছে, কার সন্তান চোর, কার বাবা-মা কী ছিলেন—এমনকি কার নানা-নানির নাম কী—এসব নোংরা আক্রমণের পাশাপাশি বড় দুটো দলের কে কোন দেশের টাকা খেয়ে নির্বাচন করেছে—এসব বিতর্ক অব্যাহত থাকলে বাংলাদেশের রাজনীতির দৈন্য আরও প্রকট হয়ে উঠবে।

২.
বাংলাদেশের রাজনীতিতে ভারত ও পাকিস্তান প্রসঙ্গ অপ্রাসঙ্গিক নয়। ১৯৪৭ সালের দেশভাগ আর সে সময়ের সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার স্মৃতি তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে কোনো কোনো মহলের রাজনীতিতে প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছে। আবার ১৯৫২-এর ভাষা আন্দোলন আর ১৯৫৪ সালের নির্বাচনের পর থেকে এ অঞ্চলের প্রতি পাকিস্তানের বঞ্চনা আরও প্রকট হয়ে উঠলে রাজনীতির পরিভাষায় ‘পশ্চিমা শাসকগোষ্ঠী’ চরম নিন্দনীয় বিষয় হয়ে ওঠে। ন্যাপ প্রতিষ্ঠার জন্য মওলানা ভাসানীকে ভারতের দালাল আর ‘৯৬ শতাংশ স্বায়ত্তশাসন অর্জিত হয়েছে’ বলে ঘোষণার জন্য হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীকে পশ্চিম পাকিস্তানের দালাল হিসেবে সমালোচিত হতে হয়েছে। স্বাধীনতাযুদ্ধকালে গণহত্যাকারী পাকিস্তানি বাহিনী ও তার সহযোগী আলবদর, আলশামস বাহিনী বাংলাদেশের মুুক্তিকামী জনতাকে পাইকারিভাবে ভারতের দালাল হিসেবে অভিহিত করেছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের পর এসব বিতর্ক প্রশমিত হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তা হয়নি। দুই নেত্রীর যুগে বরং ক্রমান্বয়ে কে কার দালাল এই বিতর্ক আরও বিস্তারিত হয়েছে। বর্তমান সাফল্য বলে তেমন কিছু নেই বলে দুই নেত্রীর দল নিজ নিজ পূর্বসূরি নেতাকে দেবতার আসনে বসানোর এবং প্রতিপক্ষ পূর্বসূরি নেতাকে ধূলিসাৎ করার চেষ্টা করেছে। এর পাশাপাশি চলেছে একদল কর্তৃক আরেক দলকে ভারত বা পাকিস্তানের দালাল হিসেবে আখ্যায়িত করার প্রতিযোগিতা। একাত্তরের নির্মম বর্বরতার জন্য পাকিস্তানের প্রতি চরম ঘৃণা পোষণ করে এ দেশের সিংহভাগ মানুষ। আবার স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ে অব্যাহত বঞ্চনামূলক কর্মকাণ্ডের জন্য ভারতের প্রতিও বৈরী মনোভাব পোষণ করে অনেক মানুষ। ভারত-পাকিস্তানের দালালির কথা বলে মানুষের এই আবেগকে রাজনৈতিকভাবে ব্যবহারের চেষ্টা করা হয়েছে, ক্রমেই তা জোরদার হচ্ছে।
রাজনীতিবিদেরা নিজেদের এই বিভাজনে বিভক্ত করার চেষ্টা করছে গোটা দেশের মানুষকে। একাত্তরে পাকিস্তানি বাহিনীর বর্বরতা, এখন পর্যন্ত একাত্তরের গণহত্যার জন্য আনুষ্ঠানিক ক্ষমা না চাওয়া এবং বাংলাদেশের সম্পদ ফেরত না দেওয়ার জন্য পাকিস্তানবিরোধী মনোভাব কাজ করে দেশের যেকোনো সচেতন মানুষের মনে। কিন্তু রাজনীতিবিদেরা যে কথা ভুলে যান তা হচ্ছে, একই মানুষের মনে কাজ করতে পারে ভারতবিরোধী মনোভাবও। বাংলাদেশে স্বাধীনতাযুদ্ধে ভারতের অবিস্মরণীয় অবদান ছিল। কিন্তু সেই ভারতই যখন যৌথ নদী, দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য, সীমান্ত এবং ছিটমহল ইস্যুতে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কাজ করে তখন ভারতের প্রতি ক্ষোভ পোষণ করাও স্বাভাবিক বিষয়। যে মানুষ বাংলাদেশকে ভালোবাসে, সে বাংলাদেশের স্বার্থবিরোধী কোনো কাজ যে দেশই করুক, তার সমালোচনা করবে। যে মানুষ ১৯৭১-এর জন্য পাকিস্তানকে চরম ঘৃণা করে, সেই মানুষ তাই বিভিন্ন কারণে ভারতের প্রতিও ক্ষোভ পোষণ করতে পারে।
আমার মনে হয় না বড় দলের নেতারা এটি উপলব্ধি করতে পারেন। তাঁরা হয়তো ভাবেন, তাঁদের কারও কারও মতো এ দেশের মানুষও শুধু পাকিস্তান বা শুধু ভারতবিরোধী মনোভাব পোষণ করে। এ জন্য একটি দলকে আমরা দেখি শুধু পাকিস্তানের সমালোচনা করতে, অন্য দলের সমর্থকদের পাকিস্তানপন্থী হিসেবে আখ্যায়িত করতে। অন্য দলকে দেখি শুধু ভারতের বিরোধিতা করতে, প্রতিপক্ষ দলের সমর্থকদের ভারতপন্থী হিসেবে ভাবতে। বাংলাদেশকে ক্রমেই যেন তারা পরিণত করতে চাইছেন ভারত বনাম পাকিস্তানের যুদ্ধক্ষেত্রে।

৩.
আমি মনে করি না, দেশের সাধারণ মানুষ কে ভারতের দালাল, কে পাকিস্তানের—শুধু এটি বিবেচনা করে ভোট দেয়। তাই যদি হতো তাহলে দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ মানুষ যারা দুই প্রধান দলকে ভোট দেয়, তাদেরও আমাদের বলতে হতো ভারত বা পাকিস্তানের লোক। আওয়ামী লীগের কিছু অসুস্থ মানসিকতার মানুষ বিএনপির সমর্থকদের ঢালাওভাবে পাকিস্তানমনা ভাবতে পারেন, বিএনপির অসুস্থ মানসিকতার ব্যক্তিরা আওয়ামী লীগের সমর্থকদের একইভাবে ভারতমনা ভাবতে পারেন। কিন্তু আমার ধারণা, দেশের সিংহভাগ মানুষ এ ধরনের বিভাজনে বিশ্বাস করে না। ভোট দেওয়ার সময় ভারত বা পাকিস্তান নয়, বাংলাদেশের মানুষের স্বার্থ কতটুকু রক্ষা করা হয়েছে, তাই তাদের প্রধান বিবেচ্য বিষয় থাকে। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক সন্ত্রাস, দ্রব্যমূল্য, দলীয়করণ এবং দুর্নীতির কারণে যারা বিএনপির প্রতি চরম ক্ষুব্ধ হয়েছিল তারা ‘নির্বাচিত হলে ভারতের কাছে দেশ বিক্রি করে দেবে আওয়ামী লীগ’ এই আশঙ্কায় আবারও বিএনপিকেই ভোট দিয়েছিল, এটি বিশ্বাস করার কারণ নেই। আবার শেয়ার মার্কেটে যারা সর্বস্বান্ত হয়েছে, দ্রব্যমূল্যে যাদের নাভিশ্বাস উঠেছে, দলীয়করণের কারণে যারা চাকরি, সম্মান বা পদোন্নতি থেকে বঞ্চিত হয়েছে, সন্ত্রাস যাদের ক্ষুব্ধ করেছে তারা ‘বিএনপি পাকিস্তানের টাকা নিয়েছিল’ এই প্রচারণা শুনে আবারও আওয়ামী লীগকেই ভোট দেবে এটি ধরে নেওয়াও সম্ভবত ভুল হবে।
আমি মনে করি, ভারত বা পাকিস্তানের দালালির অভিযোগ রাজনীতিতে থাকতে পারে। এটি তথ্যভিত্তিক হলে তাতে আপত্তি করার কিছু নেই। কিন্তু সত্য-মিথ্যার বিবেচনা বাদ দিয়ে শুধু অন্ধ ভারত-পাকিস্তানকেন্দ্রিক প্রচারণায় ঝাঁপিয়ে পড়লেই ভাসমান ভোটারদের অধিকাংশকে প্রভাবিত করে নির্বাচনে জেতা যাবে এমন ভাবনা ঠিক নয়। নির্বাচনে জেতার সহজ উপায় হচ্ছে জনগণের মৌলিক পাঁচটি চাহিদা মেটানো, সুশাসন প্রদান করা, দেশের মানুষের মানবাধিকার রক্ষা করা, দেশের সম্মান বজায় রাখা। সরকারি দলকে প্রমাণ করতে হবে যে আগের সরকারের চেয়ে দৃশ্যমানভাবে তারা এসব ক্ষেত্রে অধিকতর সফল। বিরোধী দলকে মানুষের মনে এই বিশ্বাস জন্মাতে হবে যে নির্বাচিত হলে তারা নিজেদের দুঃশাসনের পুনরাবৃত্তি করবে না এবং বর্তমান সরকারের চেয়ে দেশের মানুষের স্বার্থ ভালোভাবে রক্ষা করবে।
বড় দুই দল সেই কঠিন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে কম-বেশি অনীহ। সরকারি দলগুলো তাদের জবাবদিহি ও দায়িত্ব এড়াতে জনগণকে বিভিন্নভাবে আবেগান্ধ করে কাছে টানতেই মরিয়া হয়ে থাকে।

৪.
৮২ বছর আগে পলিটিক্যাল কোয়ার্টার্লিতে আলফ্রেড জিমার্ন লিখেছিলেন, আগের পুলিশ রাষ্ট্রে গণতন্ত্রের উদ্দেশ্য ছিল সুবিধাভোগী শ্রেণীর স্বার্থ, সম্পদ ও নিরাপত্তা রক্ষার জন্য প্রশাসন পরিচালনা, কিন্তু এখনকার ইউরোপে গণতন্ত্রের লক্ষ্য হচ্ছে জনকল্যাণের পথে সব বাধা দূর করা, জনগণকে অগণিত ও বিভিন্ন প্রকারের সামাজিক সেবা প্রদান করা। ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশসহ ১২৮টি দেশের অংশগ্রহণের মাধ্যমে ইন্টার-পার্লামেন্টারি ইউনিয়ন যে সর্বজনীন ঘোষণা গ্রহণ করে তাতেও একই ধরনের কথা বলা হয়।
দেশের মানুষের কল্যাণে বহুলাংশে ব্যর্থ হয়ে রাজনৈতিক দলগুলো যখন কে কার দালাল বা কে কার টাকা খেয়েছিল এ ধরনের বিতর্ককে মুখ্য করে তোলার চেষ্টা করে, তখন মনে হয় গণতন্ত্রের আসল লক্ষ্য খুব বেশি অনুধাবন করতে পারেনি তারা এখনো।
আসিফ নজরুল: অধ্যাপক, আইন বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-03-30/news/236451

রবিবার, ১৯ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

রেশমী রুমাল আন্দোলনঃ আযাদী আন্দোলনের অমর গাঁথা

বিংশ শতাব্দীর শুরুর কথা। সময়টা ছিলো প্রথম বিশ্বযুদ্ধের মাঝামাঝি। ১৯১৪ থেকে ১৯১৯ সাল নাগাদ বিশ্বযুদ্ধ চলছিলো। একদিকে ইংরেজদের ক্ষমতার দাপট, অন্যদিকে মুসলমানদের ভাগ্য বিপর্যয়। ইংরেজ অগ্রাসনের মুখে রাজনৈতিক অগ্রাসন ছিলো সাধারণ বিষয়।অর্থনৈতিক শোষণের মাত্রা ছিল আরো প্রকট। ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক দিক থেকে অগ্রাসন ও নিপীড়ন ছিলো আরো বেশি। ইংরেজরা মুসলমানদেরকেই একমাত্র প্রতিদ্বন্দ্বী ভাবতো। শত্রু মনে করতো আলেম-উলামাকে। এর কারণ ছিলো, যখন অথর্ব মুসলমান শাসকরা প্রতিবাদ করার সাহস পর্যন্ত হারিয়ে ফেলেছিলো, সেই প্রেক্ষিতে আলেম সমাজ শুধু প্রতিবাদী হলো না, প্রতিরোধও গড়ে তুললো।


বালাকোটের যুদ্ধ থেকে ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহ পর্যন্ত আন্দোলনগুলো ব্যর্থ হওয়ার পর আলেম সমাজ চাপে পড়েন। কারণ ইংরেজ সরকার বিদ্রোহ ও গণঅভ্যুত্থানের জন্য প্রধানত আলেম সমাজকে দায়ী করে। ১৮৫৭ সালের বিদ্রোহের নেতৃত্বের জন্য আলেম সমাজকে দায়ী করে রিপোর্ট প্রদান করেন উইলিয়াম লিওর।



এরপর শুরু হয় ওলামা নির্যাতনের নির্মম ও দুর্বিষহ অধ্যায়। অর্ধ লক্ষাধিক আলেম-ওলামাকে ফাঁসি দিয়ে হত্যা করা হয়। কালাপানি,সাইপ্রাস, আন্দামান ও মাল্টায় দ্বীপান্তরে সাজা পায় হাজার হাজার আলেম। সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত,ঘর বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়া ছিলো একেবারে সাধারণ ঘটনা। প্রায় সবকটি ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেয়া হয়। সেই সময়ে শুধু দিল্লীর আনাচে কানাচেই চার সহস্রাধিক ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান চালু ছিল।


General view of Delhi in 1857

ব্যর্থতার গ্লানি ভুলে স্বাধীনতাকামী আলেম সমাজ আবার সংঘবদ্ধ হবার চেষ্টা করলেন।সে সময় বিভিন্ন সংগঠন-সংস্থার আত্মপ্রকাশ ঘটলও। কেউ কেউ আপোষকামী ধারায় গিয়ে ইংরেজের কাছে দণ্ডমণ্ডু শপে দিলো। কিন্তু আলেম সমাজ ও মুসলমানেরা স্বাধীনতার ব্যাপারে কোন ছাড় দিতে চাইলো না। বরং নির্যাতন ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশ বিরোধী চাপা ক্ষোভকে আরো বাড়িয়ে দিলো।

ইতিমধ্যে ইউরোপে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ডামাডোল শুরু হয়ে যায়। ব্রিটিশ সৈন্যরা অন্যায়ভাবে দুটি তুর্কী জাহাজ আটক করে বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষিত রচনা করতে প্রত্যক্ষ ভূমিকা পালন করলো। এর প্রতিক্রিয়া হলো দুনিয়া জুড়ে। বিশ্ব বিভক্ত হয়ে পড়লো দুটি শিবিরে। ভারত শাসক ব্রিটিশ আর তাদের মিত্র পক্ষ, আর প্রতিপক্ষে জার্মানি, অস্ট্রিয়া, হাঙ্গেরী, তুরস্ক।

জার্মানিতে অধ্যয়নরত কিছু ভারতীয় ছাত্র এবং স্বাধীনতাপ্রিয় কিছু বুদ্ধিজীবী এই সুযোগে মিত্র পক্ষের প্রতি পক্ষে ব্রিটিশ বিরোধী ভূমিকা পালন করতে সুযোগ খুঁজলো। কিছু ভারতীয় ও তুর্কী জার্মানি মিলে ভারতের ব্রিটিশ শক্তিকে আঘাত হানার পরিকল্পনা গ্রহণ করলো। এ পরিকল্পনা সফল করার জন্য আফগানিস্তানের সহায়তা জরুরী ছিল। অপর দিকে আফগান তথা কাবুলে বৃটিশপন্থী দুর্বল সরকার প্রতিষ্ঠা ছিলো। তুরস্ক থেকে সৈন্যবাহী জাহাজ ভারতে এসে ব্রিটিশ আক্রমণের জন্য আফগানের করিডোর ব্যাবহার করার কোন বিকল্প ছিল না।
তাই ক'জন স্বাধীনতাকামী ভারতীয়,তুর্কী ও জার্মান উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা কাবুল সফর করে তুর্কী বাহিনীর আক্রমণ ও বৃটিশ বিরোধী ভূমিকায় কাবুল সরকারকে উদ্বুদ্ধ করার পরিকল্পনা গ্রহণ করলেন।

এই সময় শায়খুল হিন্দ মাহমুদুল হাসান(রহ) এর নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠিত বিপ্লবী কমিটির একটি বৈঠকে পূর্ব নির্ধারিত দিনে একটি অভ্যুত্থান ঘটানো,তুর্কী ও আফগান সরকারের সাথে প্রত্যক্ষ আলাপ-আলোচনার জন্য শায়খুল হিন্দের উপর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
প্রবাসে তখন ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন জোরদার হতে থাকে। ব্রিটিশ সরকারও সতর্কতামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে। নেতৃবৃন্দের উপর নজরদারী বাড়িয়ে দেয়। মাওলানা জওহর, আজাদ ও শওকত আলী প্রমুখ ততদিনে গ্রেফতার হয়ে যান। গ্রেফতারের তালিকায় ছিলেন শায়খুল হিন্দ ও উবায়দুল্লাহ সিন্ধি(রহ) প্রমুখ। শায়খুল হিন্দ হযরত সিন্ধিকে কাবুলের পথে পাঠালেন। নিজে গ্রেফতার এড়িয়ে হিজাজের পথে রওয়ানা হবার সিদ্ধান্ত নিলেন।



Maulana Ubaidullah Sindhi (10 March 1872 -
22 August 1944)
হযরত উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে কাবুল পাঠানোর কারণ ছিলো অনেকগুলো । এর ভিতর প্রধান কারণ ছিল তিনিটি। প্রথমতঃ গ্রেফতারী এড়ানো, দ্বিতীয়তঃ কাবুল সরকারের সহযোগিতা নিশ্চিত করা , তৃতীয়তঃ আফগান সীমান্ত জুড়ে দুর্ধর্ষ স্বাধীনতা মুক্তিপ্রিয় জাতিগুলোকে সংগঠিত করে ভারতের আযাদীর সংগ্রামে কাজে লাগানোর ব্যবস্থা করা। শায়খুল হিন্দ মাওলানা মাহমুদুল হাসান(রহ) হিজাজের পথে তুরস্ক পৌঁছা জরুরী ভাবলেন দু'টো কারণে, তুরস্ক কর্তৃক ভারত অভিযানের চুক্তি চূড়ান্ত করা এবং পুরো পরিকল্পনাটি সমন্বয় করে ১৯১৭ সালের ফেব্রুয়ারি পূর্ব পরিকল্পনা মোতাবেক ভারতে ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা উদ্ধারের অভ্যুত্থান সফল করা।

১৯১৫ সালের ১৫ আগস্ট সিন্ধী সাথীদের নিয়ে কাবুলে পৌঁছেন এবং বাদশার সাথে সাক্ষাৎ করেন। এই সব সফরের খবর সংশ্লিষ্টরা ছাড়া অন্যরা কেউ জানতো না। বাদশা সিন্ধীর কথায় সন্তুষ্ট হন এবং কাবুলে ভারতের স্বাধীনতার স্বপক্ষে কাজ করার অনুমতি দেন। তুর্কি-জার্মান মিশনের সাথেও পরিচয় করিয়ে দিয়ে সমন্বিত কাজ করার পরামর্শ দেন।

Mahendra Pratap, centre, with (right to left) Maulavi Barkatullah, Werner Otto von Hentig, Kazim Bey, Walter Röhr. Kabu,1916.l

হযরত সিন্ধী কাবুল পৌঁছে অসংখ্য স্বাধীনতাকামী ভারতীয়কে দেখতে পান। তিনি একটি 'অস্থায়ী ভারত সরকার' প্রতিষ্ঠার যৌক্তিকতা খুঁজে পান। তুর্কি-জার্মান মিশনের সমন্বয়কারী প্রতিনিধি রাজা মহেন্দ্র প্রতাপকে এই সরকারের প্রেসিডেন্ট, বরকতুল্লাহকে প্রধানমন্ত্রী, হযরত সিন্ধী প্রতিরক্ষা মন্ত্রীর দায়িত্ব পালনের সিদ্ধান্ত নিলেন। এই সরকারে তুর্কী-জার্মানও ছিলো। ভারতীয়দের প্রাধান্য, হিন্দু প্রাধান্য, জার্মান পরিকল্পনা প্রভৃতি নানা বিষয়ে অস্থায়ী সরকারের ভেতর জটিলতা সৃষ্টি হতো। অসাধারণ যোগ্যতা বলে হযরত সিন্ধী অত্যন্ত দক্ষতার সাথে এই সব জটিলতা দূর করতে সক্ষম হন। কার্যত, এক সময় মাওলানা সিন্ধীই হয়ে ওঠেন অস্থায়ী সরকারের অপ্রতিদ্বন্দ্বী নেতা।


A map by Reginald Dyer illustrating the Sistan
border with Afghanistan.Dyer led the Sistan force
hunting for infiltrating German agents through much
of 1916

১৮ সেপ্টেম্বর নাগাদ শাইখুল হিন্দ বোম্বাই -জিদ্দা হয়ে অক্টোবরে মক্কা পৌঁছান। হিজাজ তথা মক্কা-মদিনা ছিলো তুর্কি খিলাফতের অংশ। মক্কায় শায়খুল হিন্দ হিজাজের গভর্নরের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি যুদ্ধমন্ত্রী আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাৎ এর প্রয়োজন অনুভব করেন। হিজাজের গভর্নর গালিব পাশা মদিনার গভর্নর বসরী পাশার নামে একটি চিঠি লিখে শায়খুল হিন্দকে আনোয়ার পাশার সাথে সাক্ষাতের ব্যবস্থা করার অনুরোধ জানান।
এই সময় হিজাজের গভর্নর গালিব পাশার প্রচুর ধর্মীয় প্রভাব ছিলো। গালিব পাশা শাইখুল হিন্দের মহৎ উদ্দেশ্য সম্পর্কে অবহিত হয়ে আরো দুটি চিঠি লেখেন। একটি ছিলো ভারতবর্ষ ও তার অঞ্চল ঘেঁষে আফগান গোত্রপতি মুসলমানদের প্রতি। এতে সমাজবাদী ইংরেজ শাসনের বিরুদ্ধে প্রত্যক্ষ সংগ্রামের আহ্বান ছিলো। ইতিহাসে এই চিঠিকে 'গালিব নামা' নামে আখ্যায়িত করা হয়। অপর চিঠির বিষয় ছিলো আফগান সরকারের প্রতি শায়খুল হিন্দের প্রস্তাব ও পরিকল্পনা মত আফগান ভূখণ্ড দিয়ে তুর্কী সৈন্য চলাচলের অনুরোধ অস্থায়ী ভারত সরকারের প্রতি। তুর্কী সরকারের স্বীকৃতি ও অনুমোদনের কথা চিঠিতে এই নিশ্চয়তাও ছিলো যে, তুর্কী বাহিনী কোনভাবেই আফগানিস্তানের কোন অংশে হস্তক্ষেপ করবে না। এটাকে ইতিহাসে 'গালিব চুক্তিনামা' হিসেবে বিবেচনা করা হয়।
শায়খুল হিন্দ মদিনায় পৌঁছে জানতে পারেন যে, আনোয়ার পাশা রওজা মোবারক জিয়ারতে আসছেন, তাই তাকে তুরস্কে যেতে হবে না। মদিনায় বসেই সাক্ষাৎ করা সম্ভব হবে। কার্যত হলোও তাই। আনোয়ার পাশার পক্ষ থেকে ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে সর্বপ্রকার সহায়তার আশ্বাস দিয়ে একটি চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।


A column of troops of the Sistan force at Gusht in
July 1916. The Force was then commanded by
Reginald Dyer, later notorious for having ordered
the Amritsar massacre.

আনোয়ার পাশা শাইখুল হিন্দকে তিনিটি চিঠি লিখে দিলেন। এর একটি অস্থায়ী ভারত সরকার ও তুর্কী সরকারের মধ্যকার চুক্তিনামা। দ্বিতীয়টি মুসলিম নেতৃবৃন্দের কাছে শায়খুল হিন্দকে সর্বাত্মক সহযোগিতার আহ্বান । তৃতীয় পত্রটি ছিলো আফগান সরকারে প্রতি। এ বিষয়বস্তু ছিলো আফগান সরকারের সম্মতিতে তুর্কী বাহিনীর ভারত অভিযানের কথা।
সিদ্ধান্ত ছিলো আফগান সরকার সম্মত থাকলে তুর্কী বাহিনী আফগান সীমান্তে অবস্থান নেবে। ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ সালে তারা ভারত প্রবেশ করবে এবং ভারতের ভেতর গণঅভ্যুত্থান ঘটাবে।



The Kaiser's invitation to Mahedra Pratap,April 1915.
The letter was delivered by Virendranath
Chattopadhyaya in Geneva.

আফগান সরকার কর্তৃক অনুমোদিত চিঠিটি ভা অনুমোদন পত্রটি মদিনায় অবস্থানরত শায়খুল হিন্দ এর মাধ্যমে তুর্কি সরকারের হাতে পৌছবে। সেই মোতাবেক তুর্কি সরকার কর্তৃক প্রদত্ত যুদ্ধের নির্দেশনামাটি ১৯১৭ সালের ১লা জানুয়ারির মধ্যে কাবুল সদর দপ্তরে পৌঁছানো হবে। সবকিছু ঠিকঠাক হলে তুর্কি বাহিনী আফগানিস্তান হয়ে ১৯ ফেব্রুয়ারি ১৯১৭ সালে ভারতে অভিযান শুরু করবে। এই সময়টিতে শায়খুল হিন্দ আফগানিস্তানে অবস্থান করে সামগ্রিক নির্দেশনা দেবেন। যথারীতি সিদ্ধান্ত মোতাবেক হিজাজ থেকে প্রদত্ত পত্রটি কাবুলে অবস্থিত অস্থায়ী ভারত সরকারকে পৌঁছানো হলো। উবায়দুল্লাহ সিন্ধির নেতৃত্বে এই চিঠি নিয়ে আফগান বাদশাহ হাবিবুল্লাহর সাথে সাক্ষাৎ হলে তিনি পররাষ্ট্র বিষয়ে চাপের কথা তুলে সম্মতি দানে দ্বিধাগ্রস্ত রইলেন। অবশ্য বাদশাহর অন্যান্য মিত্ররা এবং জনগণ ভারতের অস্থায়ী সরকারের প্রতি আন্তরিক ছিলেন। শেষ নাগাদ একটি চুক্তি হলো, আফগান সরকার নিরেপক্ষ থাকবে। তবে তুর্কী বাহিনী আফগান সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে প্রবেশ করবে। আফগান সরকার কোন আফগানী ব্যক্তিগতভাবে যুদ্ধ যেতে চাইলে আপত্তি তুলবে না। তবে ইংরেজদের কৈফিয়ত দেবে এই বলে যে, সীমান্তে উপজাতিদের বিদ্রোহে বেসামাল হয়ে তারা তুর্কী বাহিনী ঠেকাতে পারেনি ।পরিস্থিতি আফগান সরকারের নিয়ন্ত্রণের বাইরে ছিলো।



Another map by Reginald Dyer. Birjand is in the
periphery of the Lut Desert, in Persia near Afghanistan

ইংরেজ গোয়েন্দা ও শত্রু বাহিনীর কড়া পাহারায়ও তথ্য ফাঁস হবার ভীতি থেকে মাওলানা সিন্ধি ও আমির নসরুল্লাহ খান চুক্তির বিষয় ও তারিখ দক্ষ কারিগর দিয়ে একটি রেশমি রুমালে সুতার সাহায্যে আরবী ভাষায় লিখে নিলেন। শত্রুর চোখ ও তল্লাশি নির্বিঘ্ন করার জন্য এই অভিনব ব্যবস্থা গ্রহণ করে একজন নিষ্ঠাবান ভক্তকে দিয়ে মক্কায় শায়খুল হিন্দ বরাবর পাঠাবার ব্যবস্থা করা হলো। অনেকগুলো হাত বদল হয়ে রুমালটি শেখ আব্দুর রহিম এর হাতে পৌঁছে। তিনি হজ্জে গিয়ে রুমালটি শায়খুল হিন্দের হাতে দেয়ার কথা।


Nasrullah Khan, then Prime Minister of Afghanistan.
Nasrullah closely supported the Expedition.


Habibullah Khan, Emir of Afghanistan during World
War I. Habibullah was closely allied to British India.

এদিকে আমীর হাবিবুল্লাহ খান বিরাট আর্থিক সুবিধার বিনিময়ে তথ্যটি ইংরেজ সরকারের কাছে ফাঁস করে দেয়। ব্রিটিশ গোয়েন্দা পুলিশ আব্দুর রহিমের বাড়ী তল্লাশি করে রুমালটি উদ্ধার করে ফেলে। আব্দুর রহিম আত্মগোপন করে পালিয়ে যান। কথিত আছে, এই আত্মগোপন থেকে আমৃত্যু তিনি কখনো লোক সমাজে ফিরে আসেননি।

এমনিতেই ইংরেজ সরকার ও গোয়েন্দারা বেখবর ছিলোনা। তার উপর আলেম-উলামাসহ মুসলিম নেতারা ছিলেন সন্দেহের তালিকার শীর্ষে। রেশমী রুমাল ইংরেজ সরকারের হাতে পড়ার পর নির্যাতন-গ্রেফতারী পরোয়ানার মাত্রা হাজার গুণ বেড়ে যায়। আন্দোলনের প্রধান নেতা শাইখুল হিন্দ তার প্রিয় ছাত্র হোসাইন আহমদ মাদানী সহ হেজাজে গ্রেফতার হন এবং তাদেরকে মাল্টায় নির্বাসন দেওয়া হয়। আর উবাইদুল্লাহ সিন্ধীকে অনেকগুলো বছর নানা দেশে দেশে ঘুরে বেরাতে হয় মুসাফিরের মত।আরেকটি বিশ্বাসঘাতকতার ফলে স্বাধীনতার পথটি আরো পিচ্ছিল হয়ে পড়ে। আরো তিনটি দশক নির্যাতন-নিপীড়নের খুনরাঙ্গা পথ পাড়ি দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের অবসান ঘটে।
নতুন প্রজন্ম হয়তো জানেই না ব্রিটিশ মুক্তির আজাদি কত সাগর রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছিল । অজানার বিরাট শূন্যতার ভেতর রেশমী রুমাল আন্দোলন ও রুটিতে চিঠি লিখে সংবাদ সরবরাহ করে বিপ্লবের প্রেক্ষিত রচনার মত বিষয়গুলো কাহিনীই মনে হবে।

তথ্যসূত্রঃ
১)উপমহাদেশের আলেম সমাজের বিপ্লবী ঐতিহ্য( উলামায়ে হিন্দ কা শানদার মাজি এর বাংলা অনুবাদ)
২)চেপে রাখা ইতিহাস
৩)তারিখে দেওবন্দ
৪)Ansari, K.H. (1986), Pan-Islam and the Making of the Early Indian Muslim Socialist. Modern Asian Studies,
৫) উইকিপিডিয়া
৬) উবাইদুল্লাহ সিন্ধীর ডাইরি
৭)Sarkar, Sumit , Modern India
৭)Lovett, Sir Verney , A History of the Indian Nationalist Movement,

http://www.somewhereinblog.net/blog/ogropothik/29523236

সোমবার, ১৩ ফেব্রুয়ারী, ২০১২

সীমান্তে হত্যা বন্ধের দাবি, বাংলাদেশ-ভারত সাইবার-যুদ্ধ!

বাংলাদেশ ও ভারতের কম্পিউটার হ্যাকাররা সাইবার-জগতে ওয়েবসাইট বেদখল ও অকার্যকর করার প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। বিষয়টিকে এখন বলা হচ্ছে সাইবার-যুদ্ধ।
হ্যাকারদের ফেসবুক গ্রুপ, বিভিন্ন বাংলা ব্লগসাইটের একাধিক ব্লগে বাংলাদেশি হ্যাকারদের আক্রমণের হালনাগাদ তথ্য প্রকাশ করা হচ্ছে। বাংলাদেশি হ্যাকার পরিচয় দানকারীরা বলছেন, ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর (বিএসএফ) সীমান্তে হত্যকাণ্ড ও অত্যাচার বন্ধের দাবিতে বাংলাদেশি হ্যাকাররা এই সাইবার-যুদ্ধ শুরু করেছেন। টিপাইমুখ বাঁধসহ অন্যান্য বিষয়ের কথাও তাঁরা বলছেন।
৯ ফেব্রুয়ারি ভিডিও আদান-প্রদানের ওয়েবসাইট ইউটিউবে ভারত সরকারের প্রতি একটি ভিডিও বার্তা প্রকাশ করে ‘বিডি ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারস’। ভিডিওতে মুখোশ পরা একজন হ্যাকারকে যান্ত্রিক (রোবটিক) গলায় কথা বলতে দেখা যায়। তাঁর বক্তব্য হলো, ‘হ্যালো বাংলাদেশের নাগরিকরা, আমরা বাংলাদেশ ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারস। এখন সময় আমাদের চোখ খুলবার। বিএসএফ এক হাজারের বেশি বাংলাদেশি নাগরিককে হত্যা করেছে, তাদের গুলিতে আহত হয়েছে আরও ৯৮৭ বাংলাদেশি। অপহূত হয়েছে হাজারো মানুষ। এটি মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ। তারা অবিচার করছে। সংকটময় এ মুহূর্তে বাংলাদেশি নাগরিক হিসেবে আমাদের কিছু দায়িত্ববোধ রয়েছে, আমরা চাই ভারত সরকার নিরপরাধ বাংলাদেশিদের হত্যা করা বন্ধ করুক। নতুবা আমরা ভারতীয়দের বিরুদ্ধে সাইবার-যুদ্ধ শুরু করব। এটি চলতেই থাকবে।’
তথ্যমতে, গত ১৫ দিনে ভারতের বিভিন্ন ওয়েবসাইটে বাংলাদেশি হ্যাকাররা টুকটাক আক্রমণ চালালেও শুক্রবার রাত থেকে ব্যাপকভাবে আক্রমণ চলে ভারতীয় বিভিন্ন ওয়েবসাইটে। পাল্টা আক্রমণ হিসেবে ভারতীয় হ্যাকাররাও বাংলাদেশের সরকারি-বেসরকারি বেশ কিছু সাইট অচল করে দেন। তবে গতকাল রোববার দেখা যায় বাংলাদেশের বেশির ভাগ আক্রান্ত সাইট ঠিকঠাক করা হয়েছে।
অনলাইনের তথ্য অনুযায়ী, গতকাল রাত পর্যন্ত ভারতীয় প্রায় ১০ হাজার ওয়েবসাইটে হামলা চালানো হয়েছে বলে হ্যাকাররা দাবি করেছেন। এ ছাড়া হ্যাকাররা গতকাল বিএসএফের বিকল্প ওয়েবসাইট (bsf.nic.in) দখল করে সেটির প্রোগ্রামিং সংকেত (সোর্সকোড) উন্মুক্ত করে দেন। অপরদিকে ভারতীয় হ্যাকারদের দাবি অনুযায়ী বাংলাদেশের ৩০০ সাইটে আক্রমণ করা হয়েছে।
বাংলাদেশের ‘বাংলাদেশ সাইবার আর্মি’, ‘বিডি ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারস’, ‘এক্সপায়ার সাইবার আর্মি’—এই তিনটি হ্যাকার দল এই সাইবার-যুদ্ধে নেতৃত্ব দিচ্ছে। কয়েকজন হ্যাকার এই প্রতিবেদককে জানান, ‘বাংলাদেশি হ্যাকারদের সমর্থন দিয়েছে আন্তর্জাতিক হ্যাকার দল ‘অ্যানোনিমাস’। এ ছাড়া পাকিস্তান, ইন্দোনেশিয়া ও সৌদি আরবের শক্তিশালী হ্যাকাররা বাংলাদেশি হ্যাকারদের সমর্থন দিয়ে গতকাল থেকে ভারতীয় সাইটে আক্রমণ করছেন।
অপরদিকে ভারতের ‘ইন্ডিশেল’ হ্যাকার দল বাংলাদেশি সাইটগুলোতে আক্রমণে নেতৃত্ব দিচ্ছে। ইন্ডিশেল অনেকগুলো ভারতীয় ওয়েবসাইট থেকে বাংলাদেশি হ্যাকারদের হটিয়ে দিয়ে রোববার রাত পর্যন্ত সময় দিয়েছে। এই সময়ের মধ্যে ভারতের সাইটগুলোতে আক্রমণ বন্ধ না করলে বাংলাদেশের ওয়েবসাইটগুলো আক্ষরিক অর্থেই গুঁড়িয়ে দেওয়া হবে বলে ইন্ডিশেল হুমকি দিয়েছে।
প্রথম আলোয় পাঠানো ব্ল্যাকহ্যাট হ্যাকারস দলের একটি ই-মেইলে বলা হয়েছে, এই আক্রমণ চলতেই থাকবে। ওই ই-মেইলে বাংলাদেশের কোনো সাইট আক্রান্ত হলে বা আক্রমণ ঠেকাতে ওয়েবমাস্টারদের কী করতে হবে, তার পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিসচিব রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, ‘সাইবার-যুদ্ধের মতো কোনো ঘটনার কথা আমাদের জানা নেই। আমাদের সরকারি পাঁচটি সাইট গত শনিবার ঘণ্টা দেড়েকের জন্য বন্ধ ছিল, তবে তা হ্যাকিং কি না, নিশ্চিত নই।’ সচিব আরও বলেন, ‘সরকারি ওয়েবসাইটগুলো সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় রক্ষণাবেক্ষণ করে। আমরা আইসিটি মন্ত্রণালয় থেকে অনেক সময় বিশেষজ্ঞ পরামর্শ দিয়ে থাকি।’
তথ্যপ্রযুক্তির নিরাপত্তা পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা বিডি সার্টের (কম্পিউটার ইমারজেন্সি রেসপন্স টিম) চেয়ারম্যান সুমন আহমেদ প্রথম আলোকে বলেন, ‘এসব হ্যাকিংয়ের ঘটনা মূলত তরুণ প্রজন্মের প্রোগ্রামাররা ঘটিয়ে থাকেন। তবে যেহেতু পাল্টাপাল্টি আক্রমণ হচ্ছে, তাই আমাদের দিক থেকে সতর্ক থাকতে হবে। আর এই হ্যাকিংকে রাজনীতির সঙ্গে জড়ানো ঠিক হবে না। হ্যাকারদের অন্য কোনো উপায়ে দমন না করে সচেতন করতে হবে। তাঁদের বোঝাতে হবে, এসব করে কোনো ইতিবাচক ফল আসে না।’
ছদ্মনামধারী বাংলাদেশি কয়েকজন হ্যাকার প্রথম আলোকে জানান, এখন বিচ্ছিন্নভাবে ভারতীয় ওয়েবসাইটে আক্রমণ চালানো হচ্ছে। সারা বিশ্বে এখন প্রায় এক হাজার হ্যাকার এতে সক্রিয় আছেন। তিনি হুমকি দিয়ে বলেন, ‘১০ হাজার ওয়েবসাইটে আক্রমণ কিছুই না। আমাদের আসল আক্রমণ শুরুই হয়নি।’
আরও কয়েকজন হ্যাকার জানিয়েছেন, বিএসএফ সীমান্তে হত্যা বন্ধ করছে না। বারবার বলেও কোনো কাজ হচ্ছে না। তাই এই আক্রমণ। ভারতের সাইট হ্যাক করলে দুনিয়াজুড়ে বাংলাদেশের দাবিদাওয়া ছড়িয়ে যাবে। তাই আক্রমণ চলছে। ভারত সরকার দাবি মেনে নিলে আক্রমণ বন্ধ হবে।

http://www.prothom-alo.com/detail/date/2012-02-13/news/224348