Powered By Blogger

সোমবার, ৭ অক্টোবর, ২০১৩

হল-মার্কের অর্থ আত্মসাৎ----------------- সোনালী ব্যাংকের পর্ষদ সদস্যরা অভিযুক্ত হননি

দেশের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় আর্থিক কেলেঙ্কারি হল-মার্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনায় অবশেষে আদালতে অভিযোগপত্র জমা দিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। টানা এক বছর তদন্ত শেষে এই অভিযোগপত্র দেওয়া হয়। এ জন্য ২৫ জনকে অভিযুক্ত করা হয়েছে।
আজ সোমবার জমা দেওয়া ১১টি অভিযোগপত্রে সোনালী ব্যাংকের পরিচালনা পর্ষদের কারও বিরুদ্ধেই অভিযোগ আনা হয়নি। পর্ষদের সদস্যরা ছিলেন বর্তমান সরকার কর্তৃক দলীয় বিবেচনায় নিয়োগপ্রাপ্ত।
অভিযোগপত্র প্রথমে রমনা থানায় জমা দেওয়া হয়। থানা থেকে পরে অভিযোগপত্রগুলো নিয়ে যাওয়া হয় ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিমের (সিএমএম) আদালতে। দুদকের উপপরিচালক ও তদন্ত কমিটির প্রধান মীর জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে সাত সদস্যের তদন্ত দল এসব অভিযোগপত্র থানায় নিয়ে যায়।
সোনালী ব্যাংকের কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগসাজশে হোটেল রূপসী বাংলা (সাবেক শেরাটন) শাখা থেকে হল-মার্ক গ্রুপ দুই হাজার ৬৮৬ কোটি ১৪ লাখ টাকা আত্মসাৎ করে। এর মধ্যে স্বীকৃত বিলের বিপরীতে পরিশোধিত (ফান্ডেড) অর্থ হচ্ছে এক হাজার ৫৬৮ কোটি ৪৯ লাখ ৩৪ হাজার ৮৭৭ টাকা। গত বছরের ৪ অক্টোবর রাজধানীর রমনা থানায় এই অভিযোগে পৃথক ১১টি মামলা করেছিল দুদক।
মীর জয়নুল আবেদীন অভিযোগপত্র জমা দিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘এটা কোনো ঋণ নয়, ব্যাংক ডাকাতি করে অর্থ তুলে নিয়েছেন তাঁরা।’
‘ব্যাংক ডাকাতি’র জন্য অভিযুক্তরা হলেন: হল-মার্ক গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) তানভীর মাহমুদ, তাঁর স্ত্রী ও গ্রুপের চেয়ারম্যান জেসমিন ইসলাম (জামিনে আছেন), ভায়রা ভাই ও মহাব্যবস্থাপক (জিএম) তুষার আহমেদ, গ্রুপের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ম্যাক্স স্পিনিং মিলসের মালিক মীর জাকারিয়া, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনালের জিয়াউর রহমান, আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের জাহাঙ্গীর আলম, অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজের শহিদুল ইসলাম, স্টার স্পিনিং মিলসের জাহাঙ্গীর আলম, টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের পরিচালক তসলিম হাসান, প্যারাগন গ্রুপের এমডি সাইফুল ইসলাম, নকশী নিটের এমডি মো. আবদুল মালেক এবং সাভারের হেমায়েতপুরের তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকার।
‘ডাকাতি’তে সহযোগিতার জন্য হল-মার্কের বাইরে অন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন সোনালী ব্যাংকের সাবেক এমডি হুমায়ুন কবির, দুই ডিএমডি মাইনুল হক ও আতিকুর রহমান, দুই জিএম ননী গোপাল নাথ ও মীর মহিদুর রহমান (চারজনই ওএসডি), দুই ডিজিএম শেখ আলতাফ হোসেন (সাময়িক বরখাস্ত) ও মো. সফিজউদ্দিন আহমেদ (সাময়িক বরখাস্ত), দুই এজিএম মো. কামরুল হোসেন খান (সাময়িক বরখাস্ত) এবং এজাজ আহম্মেদ। এ ছাড়া রূপসী বাংলা শাখায় কাজ করতেন এমন অভিযুক্ত ব্যক্তিরা হলেন সাময়িক বরখাস্ত হওয়া ব্যবস্থাপক এ কে এম আজিজুর রহমান, সহকারী উপমহাব্যবস্থাপক মো. সাইফুল হাসান, নির্বাহী কর্মকর্তা আবদুল মতিন ও জ্যেষ্ঠ নির্বাহী কর্মকর্তা মেহেরুন্নেসা।
এই ২৫ জনের মধ্যে টি অ্যান্ড ব্রাদার্সের তসলিম হাসান, প্যারাগনের সাইফুল ইসলাম, নকশী নিটের আবদুল মালেক, তেঁতুলঝোড়া ইউনিয়নের চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিন সরকার ও সোনালী ব্যাংকের এজাজ আহম্মেদের নাম মামলার এজাহারে ছিল না।
মীর জয়নুল আবেদীন অর্থ আত্মসাতের বিষয়ে জানান, হল-মার্কের অর্থ আত্মসাতের ঘটনাটি বাংলাদেশের ইতিহাসে এক বিরল ঘটনা। এমন আত্মসাৎ এর আগে আর হয়নি। তদন্তে দেখা গেছে, ২০১১ সালের ২৯ ডিসেম্বর এক দিনে হল-মার্কের নামে রূপসী বাংলা শাখার অসাধু কর্মকর্তারা ৮০৪টি এলসি খুলেছিলেন। প্রতি মিনিটে ২ দশমিক ২৩টি করে এলসি খোলা হয়, যা অবিশ্বাস্য।
মীর জয়নুল আবেদীন আরও জানান, ১১টি মামলার প্রতিটি অভিযোগপত্রের জন্য ৭০ থেকে ৮০ জন করে সাক্ষী রয়েছে। ব্যাংকের পর্ষদকে অভিযোগপত্রে না আনার বিষয়ে তিনি বলেন, নিয়ম অনুযায়ী ঋণের ক্ষেত্রে পর্ষদের কাছে অনুমোদন নিতে হয়। আর হল-মার্ক কেলেঙ্কারির ক্ষেত্রে কোনোটাই সরাসরি বন্ধকি ঋণ নয়। এগুলো ছিল বিভিন্ন ধরনের বৈদেশিক লেনদেনের জন্য তৈরি করা বিল-ভাউচার। কিছু বিলের মাধ্যমে এরা সরাসরি ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নিয়েছে। কিছু বিলের মাধ্যমে সোনালী ব্যাংকের জামানতের দায়বদ্ধতায় অন্য ব্যাংক থেকে অর্থ তুলে নেওয়া হয়েছে। তাই এ ক্ষেত্রে পর্ষদকে জড়িত করা যায়নি। তবে পর্ষদের মধ্যে সন্দেহভাজনদের বিষয়ে অধিকতর অনুসন্ধান চলছে বলে জানান তিনি।
অভিযোগপত্রে হল-মার্কের অর্থ আত্মসাতের মূল সহযোগী হিসেবে এ কে এম আজিজুর রহমানের নাম উল্লেখ করা হয়েছে। এই আজিজুর রহমান শাখার বাইরে হোটেল সাকুরা এবং সাকুরা পেছনের ইউরেকা প্যালেসের একটি ফ্ল্যাটে ব্যাংকের প্রয়োজনীয় তথ্যাদি নিয়ে যেতেন, যা ব্যবহার করে হল-মার্কের তানভীর ও তাঁর কর্মচারীরা বিভিন্ন ধরনের বৈদেশিক বাণিজ্যসংক্রান্ত রেকর্ডপত্র তৈরি করতেন।
এসব বিষয়ে তদন্ত দলের প্রধান মীর জয়নুল আবেদীন বলেন, এ ছাড়া এলসি নিয়ে জালিয়াতির চক্রের মূল হোতা তানভীর মাহমুদ, তুষার আহমেদ, তসলিম হাসান, সাইফুল ইসলাম ও আবদুল মালেক। এই চক্রটিই পরে আরও কয়েকটি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের এলসি জালিয়াতি করা শিখিয়ে দিয়েছে।
অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে, ম্যাক্স স্পিনিং, আনোয়ারা স্পিনিং, সেঞ্চুরি ইন্টারন্যাশনাল, অ্যাপারেল এন্টারপ্রাইজ ও স্টার স্পিনিং মিলসের মালিকেরা সবাই ভুয়া। আসলে এই কথিত মালিকেরা সবাই হল-মার্কের কর্মচারী। ম্যাক্স ও আনোয়ারা স্পিনিং মিলসের বাস্তবে কোনো অস্তিত্ব নেই।

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন