Powered By Blogger

রবিবার, ২৬ জুন, ২০১১

সোনিয়া, মনমোহন কী নিয়ে আসছেন বাংলাদেশের জন্য

বর্তমান সরকারের পররাষ্ট্রনীতি কেমন চলছে­ এ প্রশ্নের জবাবে গত কিছু দিনের খবরের প্রতি লক্ষ করলে তা সহজেই বোঝা যাবে। গত ৬ জুন ভারতের পররাষ্ট্রসচিব নিরুপমা রাও দুই দিনের সফরে ঢাকায় এসেছিলেন। ১৯ জুন ভারতের সেনাপ্রধান জেনারেল বিজয় কুমার সিং বাংলাদেশ সফরে আসেন। তিনি চট্টগ্রামে বাংলাদেশ মিলিটারি অ্যাকাডেমি বিএমএ-তে পাসিং আউট প্যারেডে সালাম গ্রহণ করেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আমন্ত্রণে ভারতের ক্ষমতাসীন দল কংগ্রেসের সভাপতি সোনিয়া গান্ধী আগামী ২৫ জুলাই ঢাকায় আসবেন অটিস্টিক ও প্রতিবন্ধী শিশুদের একটা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এম এস কৃষ্ণ আসবেন তার আগে ৬ জুলাই। জুলাই মাসেই ঢাকা সফরে আসবেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। যারা জুন মাসে বাংলাদেশ সফরে এসেছেন এবং যারা জুলাই মাসে সফরে আসছেন, তারা সবাই ভারতের শীর্ষপর্যায়ের নীতিনির্ধারক ব্যক্তি। স্বাধীনতার অব্যবহিত পরে শেখ মুজিবের আমলে ইন্দিরা গান্ধীর সফরের পর এত ঘটা করে আর কখনো ভারতীয় নেতাদের বাংলাদেশ সফরে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কের ক্ষেত্রে তাদের এই সফর রাজনৈতিকভাবে অত্যন্ত গুরুত্ব বহন করে। গত বছরের জানুয়ারি মাসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার দিল্লি সফর ও ভারতকে ট্রানজিট সুবিধাদি দিয়ে চুক্তি স্বাক্ষর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। এরই ধারাবাহিকতায় দিল্লির শীর্ষ নীতিনির্ধারকদের এ সফর অনুষ্ঠিত হচ্ছে। শেখ হাসিনা যে দিল্লি চুক্তি করে এসেছেন, এখন চলছে তার বাস্তবায়ন পালা এবং এই বাস্তবায়নপ্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করার জন্যই এত সব আয়োজন। বর্তমান সরকার ক্ষমতায় থাকতেই দিল্লি চুক্তি যাতে সন্তোষজনকভাবে কার্যকর হয় সে প্রচেষ্টাই চলছে।

এখানে একটা বিষয় উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, স্বাধীনতার পর শেখ মুজিবুর রহমান বিশ্বের বৃহত্তর অঙ্গনে বাংলাদেশের প্রবেশের জন্য যে পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করেছিলেন, তার মৃত্যুর পর জিয়াউর রহমানও বস্তুত একই পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে তার বিকাশ ঘটান। এরশাদও কম-বেশি সে পররাষ্ট্রনীতিই অনুসরণ করেন। মুক্তিযুদ্ধকালে বাংলাদেশের প্রবাসী সরকারের পররাষ্ট্রনীতি ও স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতি এক ছিল না। বাংলাদেশের জন্ম হয়েছিল মার্কিন-সোভিয়েত ঠাণ্ডালড়াইয়ের সময়, যে কারণে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সমর্থন পেয়েছিল সুষ্ঠু সোভিয়েত ব্লকভুক্ত দেশগুলোর। অপর দিকে মার্কিন ব্লকভুক্ত দেশগুলো ও চীন পাকিস্তানকে সমর্থন করেছিল। প্রধানত মার্কিন ব্লকভুক্ত হওয়ায় মুসলিম আরব দেশগুলো বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করেনি। শেখ মুজিব বাংলাদেশকে সোভিয়েত ব্লকের মধ্যে সীমাবদ্ধ না রেখে সেখান থেকে বের হয়ে আসার চেষ্টা করেন। এ জন্য তিনি (মার্কিন) যুক্তরাষ্ট্র, চীন ও সৌদি আরবসহ মুসলিম দেশগুলোর স্বীকৃতির জন্য জোর কূটনৈতিক তৎপরতা শুরু করেন। ১৯৭২ সালে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেও মুসলিম আরব দেশগুলো স্বীকৃতি দেয়া থেকে বিরত থাকে। ১৯৭৪ সালে পাকিস্তানের লাহোরে মুসলিম দেশগুলোর সংগঠন ওআইসির সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। স্বাধীন বাংলাদেশ তখন বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলমান অধ্যুষিত দেশ। বাংলাদেশকেও ওআইসি সম্মেলনে আমন্ত্রণ জানানো হয় এবং ওআইসির কয়েকজন নেতা ঢাকায় আসেন শেখ মুজিবকে ওই সম্মেলনে নিয়ে যাওয়ার জন্য। শেখ মুজিব এই সুযোগ গ্রহণ করে লাহোরে ওআইসি সম্মেলনে যোগদান করেন।

এরপরই সৌদি আরব ও পাকিস্তানসহ বিভিন্ন মুসলিম দেশ বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়। স্বাভাবিক কারণেই ইন্দিরা গান্ধীর দিল্লি সরকার শেখ মুজিবের ওআইসি সম্মেলনে যোগদান সুনজরে দেখেনি। বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে সন্দেহ ও তিক্ততার বীজ রোপিত হয় এ সময়ই। বাংলাদেশের প্রতি ভারতের মনোভাব ও আচরণের কারণে শেখ মুজিবের আমলেই কিভাবে সম্পর্কের অবনতি ঘটে তার আরেকটি উদাহরণ দেয়া যেতে পারে। দুই দেশের মধ্যে ছিটমহল বিনিময়ের জন্য ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশ ও ভারত একটি চুক্তি স্বাক্ষর করে। চুক্তি স্বাক্ষরের পর বাংলাদেশের পার্লামেন্টে তা অনুমোদিত হয়। কিন্তু অনুমোদনের জন্য ভারত সরকার তা পার্লামেন্টে কোনো দিনই উথাপন করেনি। ৩৫ বছর পর আজো তা অননুমোদিত অবস্খায়ই রয়ে গেছে। ছিটমহলগুলোর ওপর বাংলাদেশের অধিকার প্রতিষ্ঠিত হলে ১০ লাখ একর জমি আমাদের ভূখণ্ডের অন্তর্ভুক্ত হতো। এই বিরাট ভূখণ্ড হাতছাড়া হয়ে যাবে বলে দিল্লি চুক্তিটি পার্লামেন্টে অনুমোদন করায়নি। বেরুবাড়ি ভারতের কাছে হস্তান্তর করা হলেও বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে দহগ্রাম-আঙ্গরপোতা ছিটমহল যাতায়াতের জন্য তিন বিঘা করিডোর পায়নি। সমুদ্রসীমা চিহ্নিত করার উদ্যোগ শেখ মুজিবের আমলেই গ্রহণ করা হয়েছিল, কিন্তু ভারতের অপ্রতিবেশীসুলভ মনোভাবের কারণে সে উদ্যোগ ব্যর্থ হয়ে যায়।

এসব ঘটনা থেকে স্পষ্ট বোঝা যায় কিভাবে স্বাধীনতার গোড়া থেকেই বাংলাদেশ-ভারত সম্পর্কে আস্খার সঙ্কট সৃষ্টি হয়, যার জন্য ভারতের স্বার্থপর অনুদার নীতিই দায়ী। পরবর্তীকালে এই আস্খার সঙ্কট গভীর হয় অভিন্ন নদীগুলোর পানির হিস্যা ও সীমান্ত সংঘর্ষসহ বিভিন্ন ইস্যুতে। আস্খার সঙ্কট সৃষ্টির জন্য দায়ী এসব কারণের ফয়সালা ছাড়াই বর্তমান সরকার ভারতের সাথে শর্তহীনভাবে উষ্ণ ও ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক স্খাপনের জন্য যে আপস করে তা বাংলাদেশের পররাষ্ট্রনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়েছে। বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় স্বার্থের পরিপন্থী এই পররাষ্ট্রনীতির সূত্রপাত ফখরুদ্দীনের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ের। পররাষ্ট্র উপদেষ্টা ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেছিলেন, তিনি ভারতের সাথে বাংলাদেশের সম্পর্ক এমন একপর্যায়ে নিয়ে যাবেন, যা আর পরিবর্তন করা সম্ভব হবে না। জেনারেল মইনের দিল্লি সফর সে পরিবর্তনের ভিত রচনায় সাহায্য করে। বর্তমান সরকারের ভাষায় বাংলাদেশ ট্রানজিটের দেশ, অর্থাৎ বাংলাদেশের জন্মই হয়েছে ভারতকে ট্রানজিট দেয়ার জন্য। অন্য কথায়, বাংলাদেশকে স্বাধীনতা অর্জনে ভারতের সাহায্য করার অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল তাকে ভারতের করিডোর হিসেবে ব্যবহার করা। ভারতের অ্যাগ্রেসিভ ডিপ্লোম্যাসির কাছে আমাদের সরকারের আত্মসমর্পণের নীতি ভারতের সে উদ্দেশ্যকে পূরণ করেছে। এই পররাষ্ট্রনীতি চীনসহ প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছেও বাংলাদেশের ভাবমর্যাদা ক্ষুণ্ন করেছে।

ভারতীয় নেতা-নেত্রীদের সফরসূচি অনুসারে জুলাই মাসে ঢাকা কূটনৈতিক তৎপরতার দিক থেকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। কংগ্রেস সভাপতি সোনিয়া গান্ধীর জন্য উষ্ণ অভ্যর্থনার আয়োজন করা হবে, তবে তা কিভাবে করা হবে, এখনো বিস্তারিত জানা যায়নি। সোনিয়া গান্ধীর পরেই আসবেন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিং। শীর্ষপর্যায়ে আলোচনা হবে দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে। শেখ হাসিনা দিল্লি সফরের সময় যে সমঝোতা চুক্তি স্বাক্ষর করে এসেছেন, বিশেষত ট্রানজিট সুবিধা বাস্তবায়নে কতটুকু অগ্রগতি হয়েছে তা পর্যালোচনাই হবে শীর্ষ বৈঠকের প্রধান আলোচ্য বিষয়। এ ছাড়া আলোচ্যসূচিতে ছিটমহল বিনিময়, সীমান্ত পরিস্খিতি, তিস্তা নদীর পানিবন্টন চুক্তিসহ আরো কিছু দ্বিপক্ষীয় বিষয় থাকবে বলে প্রাথমিকভাবে জানা গেছে। এখানে বিশেষভাবে যা লক্ষণীয় তা হচ্ছে, এসব দ্বিপক্ষীয় ইস্যুর সমাধান ঘনিষ্ঠ প্রতিবেশী দেশ হিসেবে বাংলাদেশের ন্যায্য প্রাপ্য, বাংলাদেশের কাছে ট্রানজিট বা করিডোর ভারতের প্রাপ্য নয়। হাসিনা-মনমোহন আলোচনার ফলে বাংলাদেশ যা-ই পাক না কেন, তা ট্রানজিটের বিনিময় হতে পারে না।

ইতোমধ্যে গত সপ্তাহে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপুমণি চীন সফরে গেছেন। চীন সফরের উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, কক্সবাজারের সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, কুনমিং-টেকনাফ সরাসরি সড়ক ও রেলযোগাযোগ স্খাপনে সহযোগিতা, দুই দেশের মধ্যে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে কার্যকর পদক্ষেপ এবং বিভিন্ন প্রকল্প সহায়তা নিয়ে আলোচনা হবে। দীপুমণি চীনের ভাইস প্রেসিডেন্ট শি জিনজিং, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ইয়াং জাইচি, ঊর্ধ্বতন সরকারি কর্মকর্তা ও রাজনৈতিক নেতাদের সাথে বৈঠক করবেন। তার মূল উদ্দেশ্য হয়তো তা নয়। অতিমাত্রায় দিল্লিপ্রীতির ফলে পররাষ্ট্রনীতিতে যে ভারসাম্যহীনতা দেখা দিয়েছে, কিছুটা সামাল দেয়ার জন্যই তিনি চীন সফরে গেছেন। ড. মুহাম্মদ ইউনূসের ঘটনায় এরই মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের অবনতি ঘটেছে। যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে জামায়াত নেতাদের গ্রেফতার ও বিচারপ্রক্রিয়া শুরু করায় সৌদি আরবের সাথে শীতল সম্পর্ক চলছে; অতিমাত্রায় ভারতপ্রীতির কারণে যদি চীন বন্ধুত্বের হাত সঙ্কুচিত করে, তাহলে আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে বাংলাদেশ কি বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়বে না? 

http://www.sonarbangladesh.com/articles/AmanullahKabir  

কোন মন্তব্য নেই:

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন